পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৭২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8وقابقا প্রবাসী ১N®৪ই করিয়া দিয়া তিনি আপনার বহু পুণ্য ও অল্প পাপের বোঝা লইয়া বিধাতার বিচারালয়ে হিসাব মিটাইতে চলিয়া গেলেন। ইহলোকে তাহার মিথ্যার বোঝা বাড়িতে পাইল না। পিতা যেখানে একাধারে কর্তা ও গৃহিণী সেখানে কন্যাদের আর বেশীদিন স্থবিধা হইল না, মাতৃঋণের স্বতি বুকে লইয়া তাহারা আপন আপন দুঃখের ঘরে ফিরিয়া গেল । রমাপ্রসাদের মনে একটা সাত্বনা রহিল যে স্ত্রীকে তিনি জাজীবন ঐশ্বৰ্য্য-সমারোহের মধ্যেই রাখিতে পারিয়াছিলেন। না হইলে একটি মাত্র মামুষের মৃত্যুর পর সংসারের খরচ সিকি হইয়া যায় কি করিয়া ? সংসারে এখন দুইটি মাত্র মানুষ—বিপত্নীক রমাপ্রসাদ ও র্তাহার স্বামী-বিরহিণী কন্যা কৃষ্ণা ! রোগে শোকে শেষ বয়সে রমাপ্রসাদের স্বভাবের উপরের কর্কশ আবরণটা অনেকখানি ক্ষয় পাইয়া মমতার ফল্গুধারা প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে। সেই জন্য ঘরের একমাত্র সঙ্গী কৃষ্ণার সহিত আজকাল তাহার একটা সৌহার্দ্য দেখা যায়। নিঃসঙ্গ জীবনে তাহার সকলদিকের আশ্রয় ও অবলম্বনই এখন কৃষ্ণা । স্বামীর সঙ্গে কৃষ্ণার পরিচয় মাত্র দুই সপ্তাহের ; তাহার পরই সে সাগরপারে জ্ঞান ও অর্থের আকর বিলাতী ডিগ্রি সংগ্ৰহ করিতে চলিয়া গিয়াছে। বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিয়া সে যখন অজস্র অর্থের জৌলুসে গৃহসংসার সমুজ্জল করিয়া তুলিবে তখন রাধারাণী পাড়ার লোককে ডাকিয়া গৰ্ব্বভরে জামাতার গুণপন ব্যাখ্যা করিতে পারিবেন না এ দুঃখ রমাপ্রসাদ ও কৃষ্ণ দুজনেরই মনে আজও লাগিয়া আছে। কৃষ্ণার বয়স কম হইলেও সে জানিত যে পাচ জনের কাছে কুরূপী কন্যা ও অক্ষম জামাতাদের পরিচয় দিতে মায়ের মনে লজার অবধি ছিল না । মা দিদিদের পিছনে রাখিয়া তাহাকে সৰ্ব্বদা সকলের সামনে আগে দাড় করাইতেন, ইহাতে দিদির কৃষ্ণার উপরেই চটিয়া আগুন হইত। নূতন জামাতাটিকেও পুরাতন জামাতাদের আগে আগে দাড় করাইতে মাজার নাই, ইহাতে পুরাতন জামাতাদের মনে যতই সাম্বন থাকুক, মা নূতন আনন্দের মূল্যটুকু দিয়া পাওনা পাইবার আগেই ধে চলিয়া গেলেন তাহাতে কৃষ্ণার দুঃখ চিরস্থায়ী হইয়া রহিল । যে-বয়সে অধিকাংশ বাঙালীর মেয়ে সস্তানসন্ততি লইয়া বাস্তবজীবনের অসংখ্য খুঁটিনাটির ভিতর নিজেকে হারাইয়া ফেলে, সে-বয়সে কৃষ্ণার নিজের জীবনটা হইয়া উঠিল প্রায় সমস্তটাই ভবিষ্যতের স্বপ্ন। কিন্তু পিতার জীবনের অধিকাংশই তাহাকে অবলম্বন করিয়া চলিত বলিয়া জীবনটাকে তাহার বর্তমান ও ভবিষ্যতের জাগরণ ও স্বপ্ন ছুইয়ের জন্যই তৈয়ারী রাখিতে হইত। যতক্ষণ পিতার সম্মুখে থাকিত কি তাহারই কাজে থাকিত ততক্ষশ সকল দুঃখ ও ব্যথা হইতে পিতাকে কি করিয়া বাচাইয়া চলা যায় এই ছিল তাহার একমাত্র ভাবনা। আপনার গৃহরচনার স্বপ্ন ছিল তাহার অবসরবিনোদন। আপনাকে সেই গৃহবেদীতলে উৎসর্গ করিয়া দিবার জন্য সে যেন নানা আভরণে ভূষিত করিতেছিল। তাহার পিতৃগৃহের ঘরকবৃন, তাহার বিদ্যাসঞ্চয়, তাহার বিলাস, তাহার প্রসাধন সকলেরই ছিল সেই এক লক্ষ্য। প্রায় তিন বৎসর হইতে চলিল কৃষ্ণার স্বামী মিহির বিলাত গিয়াছে। রমাপ্রসাদের গৃহ এই কয় বৎসরেই প্রায় নূতন রূপ ধারণ করিয়াছে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর বৃহৎ সংসার ভাঙ্গিয়া যাওয়াতে র্তাহার কাপণ্যেও কেমন একটা শৈথিল্য আসিয়াছিল। কৃষ্ণা টাকা চাহিলে তিনি বিরক্ত হওয়া দূরে থাকুক বেশী করিয়াই যেন ঢালিয়া দিতেন। মেয়ের বড় ঘরে বিবাহ হইয়াছে, স্বামী বিলাত-প্রবাসী, এখন হইতে বড় রকম চালচলন না শিখিলে শ্বশুরবাড়ীতে মেয়ের মান থাকিবে না, তাহারও কুটুম্বজনের কাছে ছোট নজরের দুনাম হইবে। বিবাহের সময় কৃষ্ণাকে অলঙ্কার এবং জামাইকে অর্থ ছাড়া আর কিছু দিবার তাহার কথা ছিল না। কিন্তু তিনি বিলাতফেরত জামাইয়ের উপযুক্ত অভ্যর্থনার পাছে ক্রটি হয় বলিয়া মেয়ের ঘর আসবাবে ভরিয়া দিয়াছেন। কাপড় রাখিবার আলমারী, আপাদমস্তক দেখিবার জোড় আয়না, প্রসাধনের টেবিল, অবসরবিনোদনের অর্গান, লেখাপড়া করিবার চামড়-মোড়া টেবিল ও ঘূর্ণায়মান চেয়ার কিছুরই অভাব নাই। রমাপ্রসাদ যখন তখন বলেন, “আমি বুড়োমানুষ মা, আজকালকার সব জিনিষপত্রের নামও ত জানি না। যদি তুই ঠিক মত সব বলে দিস তবে ত আমি নিখুৎ করে মা’র ঘর সাজাতে পারি। তা তোর ত সব কথায় বুড়ো বাপের কাছেই লজ্জা ।”