পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৭৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

WԵՊՀ করতেন তখন মাসিক তাকে লক্ষাধিক টাকা পাঠানো হ’ত। পিতামহের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই প্রকাও এক ভূমিকম্পের ফলে যেন সেই বিরাট ঐশ্বৰ্য এক মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। সেই সঙ্কটের মধ্যেও পিতৃদেব অবিচলিত— বৃক্ষ ইব স্তন্ধঃ-— । তখন তিনি মন্ত্র গ্রহণ করছেন, হয়তো তখনই সম্যক উপলব্ধি করতে পারলেন উপনিষদ যে মহৎ বাণী প্রচার করে গেছে—ঈশাবাস্তমিদং সৰ্ব্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ । আমার অভিজ্ঞতার মধ্যেই দেখেছি, অনেক শোকাবহ ব্যাপারে, আত্মীয়-স্বজনের বিয়োগে বিচ্ছেদে তিনি তার সেই তেতালার ঘরে আত্মসমাহিত হয়ে একা বসে আছেন। কেউ সাহস করতে না তাকে সান্থন দিতে। বাইরের আমুকূল্যের তিনি কোনও দিন অপেক্ষ রাখেন নি ; আপনি আপনার মধ্যে আনন্দ পেতেন । আমার যখন উপনয়ন হল, দশ বছর বয়সে—মুণ্ডিত কেশ, তার জন্য একটু লজ্জিত ছিলেম—তিনি হঠাৎ আমায় ডেকে বললেন, “হিমালয়ে যেতে ইচ্ছে কর ?” আমার তখনকার কি আনন্দ, বলবার ভাষা নেই। সেকালে লুপ-লাইনটাই ছিল মেন লাইন—রাস্তায় আমাদের প্রথম বিরামের জায়গা হ’ল শান্তিনিকেতন। সে জায়গার সঙ্গে এখানকার এ জায়গার অনেক তফাৎ, ধুধু করছে প্রান্তর, স্যামল বৃক্ষচ্ছায়ার অবকাশ নেই প্রায় কোথায়ও ; সেই উষর রুক্ষ প্রাস্তরের মধ্যে, আজকাল ধেটা অতিথিশালা, তারই একটা ছোট ঘরে আমি থাকতুম, অঙ্কটাতে তিনি থাকতেন। তারই রোপণ-করা শাল-বৗখিকা তখন বড় হ’তে আরম্ভ করেছে । তখন আমার কবিতা লেখার পাগলামো তার আদিপৰ্ব্ব পেরিয়েছে ; নাট্যঘরের পাশে একটা নারিকেলগাছ ছিল, তারই তলায় বসে “পৃথ্বীরাজবিজয়" নামে একটা কবিতা রচনা করে গৰ্ব্ব অনুভব করেছিলুম। খোয়াইয়ে বেড়াতে গিয়ে নানা রকমের বিচিত্র মুড়ি সংগ্রহ করা, আর এধারে ওধারে ঘুরে গুহা-গহবর গাছপালা আবিষ্কার করাই ছিল আমার কাজ । ভোরবেলায় উঠিয়ে দিয়ে তিনি আমায় শ্ৰীভগবদগীতা থেকে তার দাগ-দেওয়া শ্লোক নকল করতে দিতেন, রাত্রে সৌরজগতের গ্ৰহতারার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন। এ ছাড়া তখন তিনি প্রবাসী S\98R র্তার এত কাছে থেকেও সৰ্ব্বদা মনে হ’ত, তিনি যেন দূরে দূরে রয়েছেন। এই সময় দেখতুম্ যে, আশপাশের লোকেরা কথায়-বাৰ্ত্তায় আলাপে-আলোচনায় তার চিত্ত বিক্ষেপ করতে সাহসই করতে না। সকালবেলা অসমাপ্ত শুকৃনো পুকুরের ধারে উচু জমিতে ও সন্ধ্যায় ছাতিম-তলায় তার যে ধ্যানের আত্মসমাহিত মূৰ্ত্তি দেখতুম্ সে আমি কখনও ভুলব না। তার পর হিমালয়ের কথা। তীব্র শীতের প্রত্যুষে প্রত্যহ ব্রাহ্মমুহূৰ্ত্তে তাকে দেখতুম, বাতি হাতে। তার দীর্ঘ দেহ লাল একটা শালে আবুত ক’রে তিনি আমায় জাগিয়ে দিয়ে উপক্রমণিকা পড়তে প্রবৃত্ত করতেন। তখন দেখতুম, আকাশে তারা, আর পর্বতের উপর প্রত্যুষের আবছায় অন্ধকারে তার পূর্বাস্ত ধ্যানমূৰ্ত্তি, তিনি যেন সেই শাস্ত স্তন্ধ আবেষ্টনের সঙ্গে একাঙ্গীভূত। এই ক'দিন র্তার নিবিড় সান্নিধ্য সত্ত্বেও এটা আমার বুঝতে দেরি হ’ত না যে, কাছে থেকেও তাকে নাগাল পাওয়া যায় না । তার পরে স্বাস্থ্যভঙ্গের সময় তিনি যখন কলকাতায় ছিলেন, তখন আমার যুবক বয়সে র্তার কাছে প্রায়ই বিষঃকৰ্ম্মের ব্যাপার নিয়ে যেতে হ’ত । প্রতিমাসের প্রথম তিনটে দিন ব্রাহ্মসমাজের খাতা, সংসারের খাত, জমিদারীর খাতা নিয়ে তার কাছে কম্পান্বিত-কলেবরে যেতুম । তার শরীর তখন শক্ত ছিল না, চোখে কম দেখতেন, তবুও শুনে শুনে অঙ্কের সামান্ত ক্রটিও তিনি চটু ক'রে ধীরে ফেলতেন। এই সময়েও তার সেই স্বভাবসিদ্ধ ঔদাসীন্য ও নির্লিপ্ততা আমায় বিস্মিত করেছে। আমাদের সকল আত্মীয়-পরিজনের মধ্যে তিনি ছিলেন তেমনি এক যেমন এক সৌরপরিবারে স্বৰ্য্য—স্বীয় উপলব্ধির জ্যোতিমণ্ডলের মধ্যে তিনি আত্মসমাঙ্গিত থাকৃতেন । তার প্রকৃতিগত নিরাসক্তির প্রকৃত দান হ’ল এই আশ্রম ; জনতা থেকে দূরে, অথচ কল্যাণস্থংে জনতার সঙ্গে আবদ্ধ। প্রকৃতির সৌন্দর্ঘ্যের মধ্যে ধে আনন্দ, এবং আত্মার আনন্দ, এই দুইয়েরও প্রতীক হ’ল এই আশ্রম। এই দুই আনন্দ মিলে তার জীবনকে পরিপূর্ণ করেছিল। ষে-চিত্তবৃত্তি থাকলে মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করা যায় সে তার ছিল না । উপনিষদের মন্ত্র উপলব্ধির জামাকে একটু-আধটু ইংরেজি ও সংস্কৃতও পড়াতেন । তবু আনন্দ তার অন্তরে নিহিত ছিল—সাধারণের জষ্টে