পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৭২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૭૧8 অন্তরে বৈরাগ্যের সঞ্চার হয়। বি-এ পড়ার সময় হঠাৎ তিনি একদিন সকলের অজ্ঞাতে গৃহ ত্যাগ করিয়া চলিয়া যান। তখন কেহ বলিয়াছিল, পরীক্ষা দিবার ভয়ে তিনি পলাতক ; কেহ বলিয়াছিল, কোন তরুণীর প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হইয়া তিনি উদাসী । সেদিন যে মুক্তিকামী যুবক জগৎ, জীবন, মানবাত্ম। সম্বন্ধে নানা প্রশ্নের কোন উত্তর না পাইয়া পরম বেদনায় দিশাহার হইয়া গৃহ-পরিবার স্থখ-সম্পদ ত্যাগ করিয়া অজান পথে বাহির হইয়াছিলেন, দশ বৎসর পর তিনি সন্ন্যাসী "সেবানন্দ’ রূপে দেশে ফিরিয়া আসিলেন । র্তাহাকে যাহার পূৰ্ব্বে উপহাস করিয়াছিল, তাহার নামে নানা মিথ্যা গুজব রটনা করিয়াছিল, তাহারাই তখন ভক্তিভরে তাহার পদপ্রান্তে বসিয়া নানা প্রার্থনা জানাইল, কেহ চাহিল আপন সস্তানের ব্যাধির জন্য ঔষধ, ধনসম্পদলাভের সহজ উপায়, কেহ জিজ্ঞাসা করিল, কেহ প্রশ্ন করিল, মুক্তি কোন পথে। সেবানন্দ স্থিতমুখে বলিয়াছিলেন, তিনি মুক্তির পথ নির্দেশ করিতে আসেন নাই, তিনি নিজে মুক্তিলাভ করিতে আসিয়াছেন, সকলকে সেবা করিয়া । মানব-সেবাই পরম ধৰ্ম্ম । দীর্ঘ জীবন ধরিয়া তিনি ভারতবর্ষের নানা স্থানে পদব্রজে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছেন, সাধু ভক্তের সঙ্গলাভ করিতে চেষ্ট করিয়াছেন, আর যখনই বঙ্গদেশে দুর্ভিক্ষ বন্যা কোন দুৰ্দ্দিন আসিয়াছে, তখনই তিনি দেশে ছুটিয়া আসিয়াছেন, দুঃস্থ গ্রামবাসিগণের সেবা করিবার জন্য । ভারতে যুগে যুগে যে সাধক-সন্ন্যাসিগণ সত্য ধৰ্ম্মের সন্ধানে গৃহ-পরিবার ত্যাগ করিয়া বাহির হইয়া গিয়াছেন, নির্জনে নিজ সাধনায় ধর্শ্বের কোন মহিমান্বিত রূপ উপলব্ধি করিয়া আবার লোকসমাজে ফিরিয়া আসিয়াছেন, কোন বিশেষ ধৰ্ম্মতত্ত্ব প্রচার করিতে বা মতবাদ প্রতিষ্ঠা করিতে নয়, ধৰ্ম্মের সহজ সত্যগুলি সরল কথায় বলিয়া মানব-সেবা করিয়া নিৰ্ম্মল জীবনযাপন করিয়া গৃহবাসীর জীবন ধৰ্ম্মময় করিয়া তুলিতে প্রয়াসী হইয়াছেন, সন্ন্যাসী-মামা সেই সাধকদের দলের । - অরুণ র্তাহাকে নূতন দৃষ্টিতে দেখিল । বাল্যকালে তাহাকে সে এক রহস্যময় পুরুষ, অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন যাদুকর বলিয়৷ জানিত, আজ তিনি দুঃখীর সেবকরূপে, সত্য পথের যাত্রীরূপে, আত্মার আত্মীয়রূপে নব-মুৰ্ত্তিতে প্রকাশিত হইয়া উঠিলেন । , প্রবাসী SN°8a আষাঢ়ের অন্ধকার রাত্রি। অরুণের ঘুম ভাঙিয়া গেল । মনে হইল, মধ্যরাত্রি হইবে। ঝমৃ-ঝম্ বৃষ্টির শব্দ । বারিধারার ঝর-ঝরধ্বনি মৃদ্ধ হইয়া আসিল । কোথা হইতে অপূৰ্ব্ব সঙ্গীত ধ্বনি আসিতেছে! সচকিত হইয়া অরুণ বিছানা হইতে উঠিল, বারান্দায় বাহির হইল । বৃহৎ প্রাচীন প্রাসাদ নিদ্রা-ভরা অন্ধকারময়। এ বৃষ্টি-মুখর অন্ধকার রাত্রে কে গান গাহিতেছে নীড়ে-জাগ পক্ষীশাবকের মত। অরুণ দক্ষিণের প্রশস্ত বারান্দার দিকে অগ্রসর হইল। বিমুগ্ধ হইয়া দেখিল, বারান্দার পূর্ব কোণে পূৰ্ব্ব দিকে মুখ করিয়া এক কম্বলের আসনে বসিয়া সন্ন্যাসী-মাম মুদিত নয়নে ভজন-গান করিতেছেন। এ গান অপরূপ । এ কণ্ঠ দিয়া গান গাওয়া নয়, প্রদীপের তৈলময় সলিত। যেমন আপনাকে পুড়াইয় আলে জালায় তেমনি এ গানের স্বরে সাধক আত্মার আনন্দ ও বেদন মূৰ্ত্তি লাভ করিতেছে। উষার বাতাসে বিকচোষ্মথ পদ্মের মত অরুণের মন কাপিতে লাগিল । ভিজে মেজেতে সে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া পড়িল । এ কি পবিত্র গভীর অনুভূতি । তাহার সমস্ত দেহ-মন কোন অতল রসের তিমিরে ডুবিয়া যাইতেছে। সংস্কৃত মন্ত্র হয়ত বেদের কোন গান । হিন্দী ভজন । ধ্যানী গায়ক গাহিয়া চলিয়াছেন, যেন সমস্ত স্বষ্টি একটি স্বরশতদলে বিকশিত হইয় উঠতে চায়। আৰ্দ্ৰ বাতাসে ভিজে মাটির গন্ধ, জুইফুলের গন্ধ । কালো মেঘের ফাকে সোনার ধারার মত স্বর্ঘ্যের আলো । তামসী রাত্রি প্রভাত হইল। অরুণ অনুভব করিল তাহার অস্তরেও যেন নব স্বর্ধ্যোদয় হইতেছে । গান শেষ করিয়া সেবানন্দ যখন উঠিয় দাড়াইলেন, অরুণের দুই চক্ষু অশ্রীতে ঝকমক করিতেছে, সে র্তাহাকে প্রণাম করিয়া দাড়াইল । —তুই এখানে বসেছিলি ? শুনছিলি গান? -—হঁ্যা মামা, কি স্বন্দর আপনার গলা । —আমার গলা মুন্দর নয় রে, চেয়ে দেখ, কি মূন্দর এই প্রভাত, কি মুন্দর এই পৃথিবী, চির-সুন্দরের স্পর্শ মনে পেলে সব সুন্দর হয়ে ওঠে । —এখন কি গঙ্গা-স্নানে যাবেন ? —ই্যা রে ।