পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৭৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

& 8 সাহায্য ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতেন। আমরা যখন অতি শিশু তখনই মা আমাদেরও মাসে চার আনা আট আনা পয়সা দিয়ে সঞ্চয় করতে শেখাতেন। সেই পয়সা জমে টাকা হ’লে আমাদের বলতেন দুর্ভিক্ষ, স্বদেশী-প্রচার প্রভৃতি কাজে নিজেদের নামে দান করতে । মা শিশুকালে বাঁকুড়ার পিত্রালয়ে এবং বিবাহের পর সেখানেই এক বাঙালী পাত্রীর স্ত্রীর কাছে সামান্ত লেখাপড়া শিখেছিলেন। তিনি সাত বৎসর বয়সে কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়তেন এবং তার ভগিনী ও সঙ্গিনীদের রামায়ণ-জ্ঞানের পরীক্ষা নিতেন, এ গল্প তার মুখে শুনেছি। আমাদের পিতামহ বাবার পনর-ষোল বৎসর বয়সে মা’র সঙ্গে তার বিবাহ দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করে পরে মৃত্যুমুখে পতিত হন। এর পর কোনো কোনো ধনী পরিবারে মা’র বিবাহের কথা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের মাতামী, পিতামহের কথা স্মরণ করে এবং বোধ হয় মা’রও ইচ্ছা তাই বুঝে অন্যত্র মা’র বিবাহ দিতে রাজি হন নি। মা নিজেই আমাদের কাছে এ গল্প করেছিলেন । বারো-তের বৎসর মাত্র বয়সেই তার বিবাহ হয়ে যায়। কিছুকাল পরে বাবা নিজে তাকে বাংলা অনেক দূর পৰ্য্যন্ত পড়িয়েছিলেন এবং ইংরেজীও কতকগুলি বই পড়িয়েছিলেন। এ ছাড়া আমরা শিশুকালে এলাহাবাদে মাকে মিস রডরিক নামের এক জন মিশনরী মেমের কাছে পড়তে এবং মিস ল্যাংলি ব'লে অন্ত এক জন মেমের কাছে বাজনা শিখতে দেখেছি। মা নিজের চেষ্টায় হিন্দী শিখেছিলেন, এবং হিন্দী বেশ ভাল ব্যাকরণসঙ্গত বলতে পারতেন, উচ্চারণ ঠিক্‌ হিন্দুস্থানী মহিলাদের মত হত। আমাদের ভাই-বোনদের মধ্যে তিন বোধ হয় মা’র কাছেই বাংলা ও ইংরেজী প্রথম পাঠ কর শিখেছিলেন। অমুস্থ অবস্থাতেও মা তার প্রথম পৌত্রীকে ংিলা লিখতে ও পড়তে শেখাতেন । নাতনীদের গান শেখাদেও ছবি আঁকতে শেখনাে তীর একটা খুব প্রিয় কাজ ছিল K হিন্দী পড়ার অভ্যাস মা কলকাতা আসার পরও কিছু রেখেছিলেন। তিনি তুলসীদাসকৃত রামায়ণ পড়তেন। কিন্তু নিজের চেষ্টায় এলাহাবাদে যে উর্দু শিখেছিলেন ও কয়েকখানা উর্দু বই পড়েছিলেন, কলকাতায় আসার পর তার চর্চা ছিল না। তিনি কলকাতায়, স্বাস্থ্যভঙ্গের পর, সম্পূর্ণ প্রবাসী ב 8סיכי নিজের চেষ্টায় কিছু সংস্কৃত শিখেছিলেন এবং কালিদাসের মূল শকুন্তলা পড়তেন ও বুঝতে পারতেন। রোগশয্যায় শুয়ে মা অন্তান্ত বইয়ের মধ্যে রবিবাবুর এই বৎসরে প্রকাশিত বইগুলি কতক পড়েছিলেন। আমরা শিশুকালে জ্ঞান হবার পর দিদিমাকে দেখি নি, ঠাকুরমাকেও অতি অল্প দিনই কাছে পেয়েছি। কিন্তু দিদিমা ঠাকুরমার কাছে গল্প শোনা পুতুল খেলা আমাদের হয় নি ব’লে আমরা এ বিষয়ে একেবারে বঞ্চিত ছিলাম না। আজ পর্য্যন্ত যত উপকথা ব্ৰতকথা শুনেছি, যত যাত্রাগান গ্রাম্য ছড়া মনে পড়ে, তার প্রায় সমস্তই ম আমাদের ছেলেবেলায় শত শত বার শুনিয়েছেন। মাটির পুতুল ময়দার পুতুল গড়ে মা আমাদের সঙ্গে সকল কাজের মধ্যেও নিত্য শিশু হয়ে খেলা করেছেন ; চার-পাচ মাস আগে পৰ্য্যন্ত সেই সব গল্প গান ছড়া মা স্ববিধা পেলেই তার নাতনীদের শোনাতেন । পুরাতন স্বদেশীসঙ্গীত ও ব্রহ্মসঙ্গীতের কত্ত গান মা তার স্বমধুর কণ্ঠে ভাবের সহিত আমাদের গেয়ে শুনিয়েছেন। মা স্বাভাবিক অতি মধুর কণ্ঠ, কল্পনাশক্তি, কবিত্বশক্তি ও তীক্ষু স্মৃতিশক্তি নিয়ে জন্মেছিলেন। যথেষ্ট স্বযোগ ও স্ববিধ পেলে এবং জীবনসংগ্রামে ও শোকে ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে না পড়লে মা মুগায়িকা এবং সম্ভবতঃ স্থলেখিকা নাম রেখে যেতে পারতেন। তার গল্প করবার ও গল্প বলবার ক্ষমতা আশ্চর্য্য ছিল। নিজ জীবনের কত ছোট ছোট স্মৃতিকথাকে তিনি যে তার দরদমাখা প্রকাশভঙ্গীর সাহায্যে ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়বন্ধুর কাছে জীবন্ত করে তুলতেন তা বলা যায় না। এখনও সে-সব গল্প মনে হ'লে মনে হয় যেন মাকে আমরাও শিশুবেশে পুকুরে, বাগানে, জঙ্গলে, কড়াইস্কটির ক্ষেতে খেলা করে বেড়াতে দেখেছি। মা তার মাসী, মাণী, ঠাকুরমা, পিদিম, মাম, জ্যেঠা সকলকার কথা আমাদের কাছে এমন ক’রে বলতেন যেন তারা সকলেই এই খানিক আগে এখানে যুরে ফিরে গিয়েছেন। তার বহু অসম্পূর্ণ রচনার মধ্যে বিশ্বপ্রকৃতিকে ভালবাসবার এবং অতি নিকটে অনুভব করবার যে স্বাভাবিক শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়, তা স্থলেখক বলে পরিচিত বহু লেকের নেই। স্বশৃঙ্খল ক'রে সাজানোর এবং চিরাচরিত বাধাধরা পদ্ধতির অনুসরণ করার চেষ্টা তার লেখায়