পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৮৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আণশ্বিন কি কিছুই বলিবার নাই, কোন মন্তব্য প্রকাশ করিবার প্রয়োজন নাই ? ইহা কি একটা সাধারণ ঘটনা ? স্বয়ং ভগবান যদি তোমার কোচমান কিংবা শোফর হন তাহা হইলে কি তোমার মনে হইবে যে এরূপ নিত্য ঘটিয়া থাকে ? পুরাকালে রথ ও সারথির উল্লেখ নানা স্থানে পাওয়া যায় । রোমানরা যুদ্ধে জয়ী হইয়া রোমে প্রত্যাগত হইলে প্রধান বন্দীরা সেনাপতি ও সৈন্তাধ্যক্ষদিগের রথচক্রের পশ্চাতে রজ্জ্ব অথবা শৃঙ্খলে বদ্ধ হইয়া নীত হইত। এক জন বিচক্ষণ জৰ্ম্মান লেখক, ডাক্তার উইলহেলম গ্রীগর, প্রাচীনকালে পূৰ্ব্বইরানের সভ্যতার ইতিহাস লিখিয়াছেন। মহাত্মা জরথুষ্ট্রের সহিত এই সভ্যতার অবিচ্ছিন্ন সম্বন্ধ। ডাক্তার গ্রীগর বহু দৃষ্টান্ত দেখাইয়া প্রমাণ করিয়াছেন যে অবস্তা জাতি, বৈদিক কালের আর্য্যজাতি, এবং হোমরের পূর্বযুগের আকিয়ান জাতি সারথিকে ভূত্য বিবেচনা করিত না, বরং রথ সারথিকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সঙ্গী মনে করিত। ঋগ্বেদে কথিত আছে, রাজকন্যা মুদগলিনী যুদ্ধক্ষেত্রে তাহার স্বামী মুগলের রথ চালনা করিয়াছিলেন। ইলিয়ড মহাকাব্যে কাপানিয়সের পুত্র ষ্টেনেলস ডাইওমিডিসের সারথি হইয়াছিলেন। প্রায়ামের উপপত্নীর পুত্র সেব্রিওনিস হেক্টরের সারথি । শল্য স্বয়ং রাজা, তিনি কর্ণের সারথি ; কর্ণ নিহত হইলে শল্য কৌরব-সেনার সেনাপতি হইলেন । কিন্তু ডাক্তার গ্রীগর চিরকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সারথি অথবা হোমরের অপেক্ষ শ্ৰেষ্ঠ মহাকাব্যের নাম পৰ্য্যস্ত শুনেন নাই । তুলনার পক্ষে মহাভারতের যুগ হোমরের যুগের অপেক্ষা আধুনিক নহে। রথী ও সারথির প্রাধান্ত যেমন ইলিয়ডে সেইরূপ মহাভারতে । কুরুক্ষেত্র এ পর্য্যন্ত নিদিষ্ট তীর্থস্থান। সেই অতিবিশাল সমরক্ষেত্রে কৌরব ও পাণ্ডব সেনা বুহিত হইয়া দণ্ডায়মান হইয়াছে। কৌরব-সেনাপতি মহামতি পিতামহ ভীষ্ম, অৰ্জুন পাণ্ডব-সেনাপতি। অশ্বের বলগা হস্তে বাস্থদেব। আদেশ হইবা মাত্র যুদ্ধ আরম্ভ হইবে । ভীষ্ম উচ্চস্বরে শঙ্খধ্বনি করিলেন, বাস্বদেব পাঞ্চজন্য শঙ্খনাদ করিলেন, অর্জুন দেবদত্ত শঙ্খ স্মাত করিলেন। অর্জন কহিলেন, অচ্যুত, উভয় সেনার মধ্যস্থলে রথ স্থাপন কর । কৃষ্ণ সেইরূপ করিলেন। পার্থ দেখিলেন অপর পক্ষে অনেকেই আত্মীয়, তাহাদিগকেই বধ করিতে হইবে। তাহার চিত্ত অবসন্ন হইল, চক্ষু 33=\రి স্ত্রীকৃষ্ণ—সারথি ও শিক্ষাগুৰু «η ηγΦ জড়িমাজড়িত হইল, দেহ কম্পিত হইল, মুখ শুষ্ক হইল, গাওঁীব তাহার হস্ত হইতে স্রস্ত হইয়া রথে পতিত হইল । ধনঞ্জয় যুদ্ধ করিতে অস্বীকৃত হইলেন। তৎক্ষণাৎ সারথি শিক্ষাগুরু হইলেন । সৰ্ব্বক্ষয়কারী যুদ্ধের প্রাক্কালে শ্ৰীমদভগবদগীতা শ্রত হইল। যুদ্ধের সংঘর্ষ ও কোলাহল শ্রত হইল না। উভয় সৈন্ত প্রথম অস্ত্রাঘাতের অপেক্ষা করিতেছিল কিন্তু কেহ আঘাত করিল না। গীতার অষ্টাদশ অধ্যায় যে-পৰ্য্যন্ত সমাপ্ত না হইল সে-পৰ্য্যস্ত কেহ অস্ত্র উত্তোলন করিল না । ত্রস্ত, চমৎকৃত, অভিভূত হইয়া সব্যসাচী শ্ৰীভগবানের রুদ্র বিশ্বরূপ দেখিলেন, যাহাতে বিশ্বচরাচর বিস্মিত হইতেছে এবং মহারথীসমূহ যাহার আস্তে প্রবেশ করিতেছেন । এই ভীতিবিধায়ক, আদি অস্তমধ্যরহিত অননুমেয় বিরাট বিশ্বরূপ আর কেহ দেখিল না। এরূপ অলৌকিক অভূতপূর্ব ঘটনা আর কোন সাহিত্যে দেখিতে পাওয়া যায় না । জগতে যত প্রকার ধৰ্ম্মশিক্ষা ও উপদেশ আছে তাহার মধ্যে এক মহত্তম ও উচ্চতম শিক্ষা যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোরতর যুদ্ধের অব্যবহিত পূৰ্ব্বে বিবৃত হয়। এই কথা স্বরণ করিলে যুদ্ধের কাহিনী সমস্তই অলীক ও রূপক বিবেচনা হয়। যুদ্ধক্ষেত্র, সমবেত অক্ষৌহিণীসমূহ মায়ার ন্যায়, ইন্দ্রজালের ন্যায়, মনের মরীচিকার ন্যায় অস্তৰ্হিত হয়। সৈন্য নাই, সেনাপতি নাই, যুদ্ধের কোন আয়োজন নাই। দেহের অন্তরস্থ আত্মা রথ, ভগবান সেই রথের সারথি, তিনি সেই রথ জীবনের ও জগতের যুদ্ধক্ষেত্রে চালনা করিয়া আত্মাকে বিজয়ী করেন। মহাকাব্য মহাভারত যে মহাযুদ্ধের আধার তাহা কাল্পনিক রূপক মাত্র । তাহা নহে। ভগবদগীতা যেরূপ সত্য কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধও সেইরূপ বাস্তব। ভোজবিদ্যার কৌশল এই যে এরূপ মহতী শিক্ষা এরূপ অভাবনীয় স্থানে সন্নিবেশিত হইয়াছে। ধৰ্ম্মশিক্ষার উপযুক্ত স্থান তপোবন, আর্য্য ঋষিগণ শাস্ত উপবন আশ্রমে শিষ্যদিগকে ধর্মের গূঢ় তত্ত্ব শিখাইতেন । গীতা মূল মহাভারতের অঙ্গ বিবেচনা হয় না । ভাষার গৌরব গাম্ভীৰ্য্যে, ছন্দের উদার মন্ত্ৰে বৈলক্ষণ্য লক্ষিত হয় । গীতা মহাভারতের পরে রচিত ও কোন বিশেষ উদ্দেশ্বে এমন স্থলে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে, এরূপ অনুমান কুরিবার,কারণ আছে। বুদ্ধদেবের