পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্রনাথের পত্র শাস্তিনিকেতন কল্যাণীয়েৰু অমিয়, প্রায় এক মাস ধরে ঘুরেছি। এবারে বেরিয়েছিলুম পশ্চিম-ভারতের অভিমুখে । গিয়েছি লাহোর পর্যন্ত । এই কারণে চিঠিপত্র অনেক কাল বন্ধ ! শাস্তিনিকেতনে যখন আপনাদের ভাবে ও কাজে বেষ্টিত হয়ে থাকি, তখন সমগ্র ভারতের বর্তমান ঐতিহাসিক রূপটা প্রত্যক্ষ দেখতে পাই নে। এবারে মুক্তিটা দেখা গেল। তুমি যে মহাদেশে আছ সেখানে মানুষের চিত্ত-সমুদ্রে স্বরামুরের মন্থন চলছে, আবৰ্ত্তিত হয়ে উঠছে বিয এবং অমৃত প্রকাও পরিমাণে । সেখানে চিন্তা বলো, কৰ্ম্ম বলো, কল্পনার লীলা বলে সমস্তের মধ্যেই একটা বিরাট বেগের উৎক্ষেপ বিক্ষেপ নিরস্তর চলেছে—প্রত্যেক মানুষের জীবনে সেখানে সমস্ত মানুষের উদ্বেল জীবনের আঘাত প্রতিঘাত কেবলই কাজ করছে। সেখানে মানুষের সম্মিলিত শক্তি ব্যক্তিগত শক্তিকে অহরহ রাখছে জাগিয়ে । তারতবর্ষের দিগপ্ত আবদ্ধ হয়ে রয়েছে সঙ্কীর্ণতার প্রাচীরে । সেই বেড়ার মধ্যে যা হচ্ছে তাই হচ্ছে, তার বাইরের দিকে বেরোবার কোনো গতি নেই। যেখানে জীবনের ভূমিকা এত ছোট সেখানে মানুষের কোনো চেষ্টা চিরস্তনের ক্ষেত্রে কোনো বৃহৎ রূপ প্রকাশ করবে কিসের জোরে । ইতিহাসের যে পটে আমাদের ছবি উঠেছে সে ছিন্ন ছিন্ন পট, তার চিত্রের রেখা ক্ষীণ, বর্ণ অনুজ্বল, তাতে প্রবল মনুষ্যত্বের স্পষ্টতা ব্যক্ত হবার পরিপ্রেক্ষণিক পাওয়া যায় না। তাই আমাদের পলিটিক্স, সাহিত্য, কলাবিদ্যা সব কিছুরই মাপকাঠি ছোট। এই নিয়ে মহাজাতির পরিচয় গড়ে তোলা অসম্ভব। এই পরিচয়ের অভাবে আমাদের আত্মসন্মানবোধের আদর্শ নীচে নেমে যায় । সৰ্ব্বত্রই দেখা গেল হোয়াইট পেপার নিয়ে আলোচনা চলছে । ছেলেবেলায় কাঙালীবিদায়ের যে দৃশু দেখেছি তাই মনে পড়ে। ধনীর প্রাসাদ অভ্ৰভেদী, তার সদর ফাটক বন্ধ । বাহিরের আঙিনায় জীর্ণচীর পর ভিক্ষুকের ভীড় । কেউ পায় চার পয়সা, কেউ দু-জান, কেউ চার আন ৷ তকমাপর দ্বারীদের সঙ্গে তাদের যে দাবীর সম্বন্ধ তা কেবল কণ্ঠের জোরে । এই জন্তে তার স্বরের চর্চাটাই প্রবল হয়ে উঠেছে। সব চেয়ে যেটা লজ্জা, সে এই ভিক্ষুকদের নিজেদের মধ্যে কাড়াকড়ি ছেড়াছেড়ি নিয়ে। যে ব্যক্তি দান করছে, মৃদুর উৰ্দ্ধে দোতলার বারানায় তাদের আত্মীয়কুটুম্বের মজলিশ । যত কম দিয়ে যত বেশি দেওয়ার ভড়ং করা যেতে পারে স্বভাবতই তাদের সেই দিকে দৃষ্টি। রাজদ্বারীদের এক হাতে সিকি দুয়ানির থলি, আরেক হাতে লাঠি ; সেটা পড়ছে, যারা বেশি চীৎকার করে তাদের মাথার পরে । দেখতে দেখতে হিন্দু-মুসলমানের ভেদ অসহ হয়ে উঠল, এর মধ্যে ভাবী কালের যে সুচনা দেখা যাচ্ছে তা রক্তপন্ধিল। লক্ষেীয়ে এক জন মুসলমান ভদ্রলোক আক্ষেপ ক’রে বলছিলেন, কী করা যায়। আমি বললুম, রাষ্ট্রীয় বকৃতামঞ্চে নয়, কাজের ভিতর দিয়ে মিলতে হবে। আজকাল পল্লীগঠনের যে উদ্যোগ আরম্ভ হয়েছে সেই উপলক্ষ্যে উভয় সম্প্রদায়ের সমবেত চেষ্টার ঐক্যবন্ধন স্বস্ট হতে পারে। তিনি বললেন আগা ধ। এই কাজে মুসলমানদের স্বতন্ত্র হয়ে চেষ্টা করতে মন্ত্রণা দিচ্ছে। পাছে গান্ধিজীর অনুষ্ঠানে পল্লীবাসী হিন্দু মুসলমানের মধ্যে আপনি মিলন ঘটে সেই সম্ভাবনাটাকে দূর করবার অভিপ্রায়ে এই দৌত্য। বর্তমান ভারতের রাষ্ট্রনীতিতে হিন্দুর সঙ্গে পৃথক হওয়াই মুসলমানের স্বার্থরক্ষার প্রধান উপায় । এতকাল ধৰ্ম্মে যে দুই সম্প্রদায়কে পৃথক করেছিল আজ অর্থেও তাদের পৃথক করে দিল— মিলব কোন শুভবুদ্ধিতে আপীল ক’রে ? না মিললে ভারতে স্বায়ত্বশাসন হবে ফুটো কলসিতে জল ভরা । কোনো এক সময়ে যুরোপে যখন প্রলয়কাও ঘটবে তখন ইংরেজের শিথিল মুষ্টি থেকে ভারতবর্ষ খসে পড়বেই। কিন্তু ভারতবর্ষের মতো এত বড় দেশে দুই প্রতিবেশী জাতির মজ্জায় মজ্জায় এই যে বিষবৃক্ষ আজ বৰ্দ্ধিত ও শাখারিত হ’ল কবে আমরা তাকে উৎপাটিত করতে পারব ?