পাতা:প্রবাসী (সপ্তম ভাগ, দ্বিতীয়াংশ).djvu/১৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Q eVシ তাহার স্বদেশের সমস্ত দুঃখ দুৰ্গতি দুৰ্ব্বলতা ভেদ করিয়াও একটা মহৎ সত্য পদার্থকে প্রত্যক্ষবৎ দেখিতে পাইত,-সেই জন্ত দেশের দরিদ্র্যকে কিছুমাত্র অস্বীকার না করিয়া ও সে দেশের প্রতি এমন একটি বলিষ্ঠ শ্ৰদ্ধা স্থাপন করিয়াছিল, দেশের অন্তর্নিহিত শক্তির প্রতি এমন তাহার অবিচলিত বিশ্বাস ছিল যে, তাহার কাছে আসিলে, তাহার দ্বিধাবিহীন দেশভক্তির বাণী শুনিলে সংশয়ীকে হার মানিতে হইত। গোরার এই অক্ষুণ্ণ ভক্তির সম্মুখে হারানের অবজ্ঞাপূর্ণ তর্ক সুচরিতাকে প্রতি মুহুর্তে যেন অপমানের মত বাজিতেছিল । সে মাঝে মাঝে সঙ্কোচ বিসর্জন দিয়া উচ্ছসিত হৃদয়ে প্রতিবাদ না করিয়া থাকিতে পারে নাই। তাহার পরে হারান যখন গোর ও বিনয়ের অসাক্ষাতে ক্ষুদ্র ঈর্ষাবশত তাহদের প্রতি অভদ্রতার অপবাদ আরোপ করিলেন তখনও এই অণ্ঠায় ক্ষুদ্রতার বিরুদ্ধে সুচরিতাকে গোরাদের পক্ষে দাড়াইতে ইষ্টল। অথচ গোরার বিরুদ্ধে সুচরিতার মনের বিদ্রোহ একেবারেই যে শাস্ত হইয়াছে তাহাও নহে। গোরার একপ্রকার গায়ে-পড়া উদ্ধত হিন্দুয়ানি তাহাকে এখনো মনে মনে আঘাত করিতেছিল। সে একরকম করিয়া বুঝিতে পারিতেছিল এই হিন্দুস্থানির মধ্যে একটা প্রতিকূলতার ভাব আছে—ইহা সহজ প্রশান্ত নহে--ইহা নিজের ভক্তি বিশ্বাসের মধ্যে পর্য্যাপ্ত নহে—ইহা অন্তকে আঘাত করিবার জন্ত সৰ্ব্বদাই উগ্রভাবে উদ্যত । সে দিন সন্ধ্যায় সকল কথায় সকল কাজে আহর করিবার কালে, লীলাকে গল্প বলিবার সময় ক্রমাগতই সুচরিতার মনের তলদেশে একটা কিসের বেদন কেবলি পীড়া দিতে লাগিল--তাহা কোনোমতেই সে দূর করিতে পারিল না । কঁাটা কোথায় আছে তাহ জানিতে পারিলে তবে কাটা তুলিয়া ফেলিতে পারা যায়। মনের কাটাটি খুজিয়া বাহির করিবার জন্য সেদিন রাত্রে স্বচরিতা সেই গাড়িবারান্দার ছাতে একলা বসিয়া রহিল। রাত্রের স্নিগ্ধ অন্ধকার দিয়া সে নিজের মনের অকারণ তাপ যেন মুছিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিল কিন্তু কোনো ফল হইল না। তাহার বুকের অনির্দেশু বোঝাটার জন্য তাহার কঁদিতে ইচ্ছা করিল কিন্তু কান্না আসিল না। প্রবাসী । [ ৭ম ভাগ একজন অপরিচিত যুবা কপালে তিলক কাটিয়াআসিয়াছে অথবা তাহাকে তর্কে পরাস্ত করিয়া তাহার অহঙ্কার নত করা গেল না এই জন্তই সুচরিতা এতক্ষণ ধরিয়া পীড়া বোধ করিতেছে ইহার অপেক্ষা অদ্ভুত হাস্যকর কিছুই হইতে পারে না। এই কারণটাকে সম্পূর্ণ অসম্ভব বলিয়া মন হইতে সে বিদায় করিয়া দিল। তখন আসল কারণটা মনে পড়িল এবং মনে পড়িয়া তাহার ভারি লজ্জা বোধ হইল। আজ তিন চার ঘণ্টা সুচরিত। সেই যুবকের সম্মুথেই বসিয়াছিল এবং মাঝে মাঝে তাহার পক্ষ অবলম্বন করিয়া তকেও যোগ দিয়াছে অথচ সে তাহাকে একেবারে যেন লক্ষ্য মাত্রই করে নাই ; – যাবার সময়েও তাহাকে সে যেন চোখে দেখিতেই পাইল না। এই পরিপূর্ণ উপেক্ষাই যে সুচরিতাকে গভীর ভাবে বিধিয়াছে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই । বাহিরের মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশায় অনভ্যাস থাকিলে যে একটা সঙ্কোচ জন্মে, বিনয়ের ব্যবহারে যে একটি সঙ্কোচের পরিচয় পাওয়া যায়--সেই সঙ্কোচের মধ্যে একটা সলজ্জ নম্রতা আছে । গোরার আচরণে তাহার চিঃমাত্রও ছিল না। তাহার সেই কঠোর এবং প্রবল ঔদাসীন্ত সহ করাধা তাহাকে অবজ্ঞা করিয়া উড়াইয়া দেওয়া মুচরিতার পক্ষে আজ কেন এমন অসম্ভব হইয়া উঠিল ? এত বড় উপেক্ষার সম্মুখেও সে যে আত্মসম্বরণ না করিয়া তর্কে যোগ দিয়াছিল, নিজের এই প্ৰগল্‌ভতায় সে যেন মরিয়া যাইতেছিল। হারানের অন্তায় তকে একবার যখন সুচরিতা অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছিল তখন গোরা তাহার মুখের দিকে চাহিয়াছিল। সে চাহনিতে সঙ্কোচের লেশমাত্র ছিল না— কিন্তু সে চাহনির ভিতরে কি ছিল তাহাও বোঝা শক্ত। তথন কি সে মনে মনে বলিতেছিল—এ মেয়েটি কি নির্লজ্জ, অথবা, ইহার অহঙ্কার তকম নয়, পুরুষমানুষের তর্কে এ অনাহূত যোগ দিতে আসে ? তাহাই যদি সে মনে করিয়া থাকে তাহাতে কি আসে যায় ? কিছুই আসে যায় না কিন্তু তবু মুচরিতা অত্যন্ত পীড়া বোধ করিতে লাগিল। এ সমস্তই ভুলিয়া যাইতে, মুছিয়া ফেলিতে সে একান্ত চেষ্টা করিল কিন্তু কোনোমতেই পারিল না। গোরার উপর তাহার রাগ হইতে লাগিল— গোরাকে সে কুসংস্কারাচ্ছন্ন উদ্ধত যুবক বলিয়া সমস্ত মনের সঙ্গে অবজ্ঞা করিতে চাহিল কিন্তু তবু সেইবিপুলকায় বজ্রকণ্ঠ