পাতা:প্রবাসী (সপ্তম ভাগ, দ্বিতীয়াংশ).djvu/১৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

شd e b স্বচরিতা হাসিয়া ককিল—“কি রকমই বটে!” বলিয়া গোরার সেই উচ্চ"শুভ্র ললাটে তিলক কাটা মূৰ্ত্তিমনে আনিয়া স্বচরিতা রাগ করিল। রাগ করিবার কারণ এই যে ঐ তিলকের দ্বারা গোরা কপালে বড় বড় অক্ষরে লিখিয়া রাখিয়াছে যে তোমাদের হইতে আমি পৃথক। সেই পার্থক্যের প্রচণ্ড অভিমানকে সুচরিত। যদি ধূলিসাৎ করিয়া দিতে পারিত তবেই তাহার গায়ের জ্বালা মিটিত । আলোচনা বন্ধ হইল, ক্রমে দুইজনে ঘুমাইয়া পড়িল । রাত্রি যখন দুইটা স্বচরিষ্ঠ জাগিয়া দেখিল, বাহিরে ঝম ঝম্‌ করিয়া বৃষ্টি হইতেছে ; মাঝে মাঝে তাহদের মশারির আবরণ ভেদ করিয়া বিদ্যুতের আলো চমকিয়া উঠিতেছে ; ঘরের কোণে যে প্রদীপ ছিল সেটা নিবিয়া গেছে । সেই রাত্রির নিস্তব্ধতায়, অন্ধকারে, অবিশ্রাম বৃষ্টির শব্দে, সুচরিতার মনের মধ্যে একটা বেদন বোধ হইতে লাগিল । সে এপাশ ওপাশ করিয়া ঘুমাইবার জন্য অনেক চেষ্টা করিল —পাশেই ললিতাকে গভীর সুপ্তিতে মগ্ন দেখিয়া তাহার ঈর্ষা জন্মিল, কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসিল না। বিরক্ত হইয় সে বিছানা ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিল । খোলা দরজার কাছে দাড়াইয়া সম্মুখের ছাতের দিকে চাহিয়া রহিল— মাঝে মাঝে বাতাসের বেগে গায়ে বৃষ্টির ছাট লাগিতে লাগিল। ঘুরিয়া ফিরিয়া আজ সন্ধ্যাবেলাকার সমস্ত ব্যাপার তন্ন তন্ন করিয়া তাহার মনে উদয় হইল। সেই স্বৰ্য্যাস্তরঞ্জিত গাড়িবারান্দার উপর গোরার উদ্দীপ্ত মুখ স্পষ্ট ছবির মত তাহার স্মৃতিতে জাগিয়া উঠিল এবং তখন তর্কের যে সমস্ত কথা কানে শুনিয়া ভুলিয়া গিয়াছিল সে সমস্তই গোরার গভীর প্রবল কণ্ঠস্বরে জড়িত হইয়া আগাগোড়া তাহার মনে পড়িল । কানে বাজিতে লাগিল—“আপনারা যাদের অশিক্ষিত বলেন, আমি তাঁহাদেরই দলে—আপনারা যাকে কুসংস্কার বলেন আমার সংস্কার তাই। যতক্ষণ না আপনি দেশকে ভাল বাসবেন এবং দেশের লোকের সঙ্গে এক জায়গায় এসে দাড়াতে পারবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার মুখ থেকে দেশের নিন্দ আমি এক বর্ণও সহ করতে পারব না।” এ কথার উত্তরে পানু বাবু কহিলেন—“এমন করলে দেশের সংশোধন হবে কি করে ?” গোরা গৰ্জ্জিয়া উঠিয়া কহিল— “সংশোধন ! সংশোধন ঢের পরের কথা। সংশোধনের প্রবাসী । [ ৭ম ভাগ । চেয়েও বড় কথা ভালবাসা, শ্রদ্ধা। আগে আমরা এক হব তাহলেই সংশোধন ভিতর থেকে আপনিই হবে। আপনারী” যে পৃথক হয়ে দেশকে খণ্ড খণ্ড করতে চান,—আপনার বলেন দেশের কুসংস্কার আছে অতএব আমরা মুসংস্কারীর দল আলাদা হয়ে থাকৃব। আমি এই কথা বলি, আমি কারো চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে কারো থেকে পৃথক হব না এই আমার সকলের চেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা–তারপর এক হলে কোন সংস্কার থাকবে কোন সংস্কার যাবে তা আমার দেশই জানে, এবং দেশের যিনি বিধাতা তিনিই জানেন ৷” পামু বাবু কহিলেন,-—“এমন সকল প্রথা ও সংস্কার আছে যা দেশকে এক হতে দিচ্চে না ।” গোরা কহিল—“যদি এই কথা মনে করেন যে আগে সেই সমস্ত প্রথা ও সংস্কারকে একে একে উৎপাটিত করে ফেলবেন তার পরে দেশ এক হবে তবে সমুদ্রকে ছেচে ফেলে সমুদ্র পার হবার চেষ্টা করা হবে। অবজ্ঞা ও অহঙ্কার দূর করে নম্র হয়ে ভালবেসে নিজেকে অন্তরের সঙ্গে সকলের করুন, সেই ভালবাসার কাছে সহস্ৰ ক্রট ও অসম্পূর্ণত সহজেই হার মানবে। সকল দেশের সকল সমাজেই ক্রটি ও অপুর্ণতা আছে কিন্তু দেশের লোকে স্বজাতির প্রতি ভালবাসার টানে যতক্ষণ এক থাবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার বিষ কাটিয়ে চলতে পারে। পড়বার কারণ হাওয়ার মধ্যেই আছে। কিন্তু বেঁচে থাকৃলেই সেট কাটিয়ে চলি, মরে গেলেই পচে উঠি। আমি আপনাকে বলচি সংশোধন করতে যদি আসেন ত আমরা সহ করব না, তা আপনারাই হোন বা মিশনারিই হোন।” পানু বাবু কহিলেন—“কেন করবেন না?” গোরা কহিল— “করব না তার কারণ আছে। বাপ মায়ের সংশোধন সহ করা যায় কিন্তু পাহারাওয়ালার সংশোধনে শোধনের চেয়ে অপমান অনেক বেশি ; সেই সংশোধন সহ করতে হলে মনুষ্যত্ব নষ্ট হয়। আগে আত্মীয় হবেন তারপরে সংশোধক হবেন—নইলে আপনার মুখের ভাল কথাতেও আমাদের অনিষ্ট হবে” –এমনি করিয়া একটি একটি সমস্ত কথা আগাগোড়া মুচরিতার মনে উঠতে লাগিল এবং এই সঙ্গে মনের মধ্যে একটা অনির্দেশু বেদনাও কেবলি পীড়া দিতে থাকিল। শ্রান্ত হইয়া স্বচরিতা বিছানায় ফিরিয়া; আসিল এবং চোখের উপর করতল চাপিয়া সমস্ত ভাবনাকে ঠেলিয়া ঘুমাইবার