পাতা:প্রবাসী (সপ্তম ভাগ, প্রথমাংশ).djvu/৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○○ সপ্তাহকাল নির্জনে উপবাসসংযমে অনুধ্যান ও অনুতাপ করিয়া চিত্তশুদ্ধি করুন ।” সপ্তাহকাল নির্জনবাস ও উপবাসের পর হতবুদ্ধি নৃসোম ধৰ্ম্মপালের নিকট আনীত হইলে ধৰ্ম্মপাল জিজ্ঞাসা করিলেন,— "ভ্রাতঃ ধৰ্ম্মবংশ, আপনি আপনার বিগত ব্যবহারের জষ্ঠ অমুক্তপ্ত হইয়াছেন ত’ ? আর কখন বিহারের নিয়ম ভঙ্গ করিবেন না ত’ ?” নৃসোম বলিল, ‘প্রভু, আমি যথেষ্ট অনুতপ্ত হইয়াছি। সপ্তাহকালের নির্জন কারাবাস এবং অৰ্দ্ধাশন, অনশন মূৰ্ত্তিমান অনুতাপ হইয়া আমাকে যথেষ্ট শিক্ষা দিয়াঁছে । আপনার আদেশ আর কথন অবহেলা করিবার মত সাহস বা সামর্থ্য আমার অবশিষ্ট নাই।’ "অতঃপর সকল উৎসবে উপস্থিত হইবেন ? ‘আজ্ঞা, উৎসব কেন, আপনার আদেশে নরকে উপস্থিত হইব । নরকযন্ত্রণ আপনার প্রদত্ত শাস্তি অপেক্ষা কঠোর মহে ।” "আপনার স্মরণ থাকে যেন যে আপনি ভিক্ষু ধৰ্ম্মবংশ ।” ‘ভিক্ষু শ্রমণ বা যাহা কিছু আদেশ করিবেন, আমি তাহাই নির্বিচারে মানিয়া লক্টব” । ‘মারের প্রশ্রয়ে আপনি আর কখন আপনার সমধৰ্ম্মীদের পাষণ্ডী বলিয়া অবহেলা করিবেন না।’ ‘আজ্ঞা, যতদিন উদরে ক্ষুধা এবং বাহিরে উপবাসের ভয় থাকিবে, ততদিন করিব না ।” শ্রমণদিগের কষ্টগুপ্ত হাস্তোচ্ছাস এই কথায় নিরুদ্ধ রাখা কঠিন হইয়া উঠিল। শ্রমণদিগের রুদ্ধ-কান্তবেগক্লিষ্ট ভাব দেখিয়া ধৰ্ম্মপাল বলিলেন, ‘ভ্ৰাতৃগণ, ধৰ্ম্মভ্রাতার প্রতি মারের আক্রমণ দেখিয়া হাস্ত করা উচিত নহে। বরং আপনারাও প্রার্থনা করুন যে, যে ভিক্ষুশ্রেষ্ঠ গোতম-সেবক ধম্মবংশ এই যুগাধিককাল শ্রামণ্যধৰ্ম্মের আদর্শীভূত ছিলেন, ঙাহার এই মার প্রভাব ভগবান তথ্যগতের আশীৰ্ব্বাদে বিদূরিত হউক। এরূপ নিঋতির অবস্থা আমাদের সকলেরই আসিতে পারে। অতএব আত্মবিচার দ্বারা সাবধান হইয়া দুঃখ প্রকাশ করুন।” এই কথা শুনিয়া সকল শ্রমণ শান্ত হইল । নৃসোম প্রবাসী। [ ৭ম ভাগ । কিন্তু অধিকতর বিপৰ্য্যস্ত হইয়া পড়িল । “আমি যুগাধিককাল এখানে শ্রমণ-ধম্মবংশ, আমি পাষণ্ডী, আমি বেদনিষ্ঠ নৃসোম নহি ? ঘটনার একটা সামঞ্জস্ত করিয়া উঠিতে পারিতেছি না কেন ? যে হয় একটা ভাব মস্তিষ্কে মুদ্রিত হইয়া গেলেই ত’ আমি বঁাচি। হায়, ইহারা ভ্রান্ত, ন, আমারই বুদ্ধি বিকৃত—ইহার মীমাংসা কে করিবে, ওগে কবে হইবে ? নৃসোমকে নিস্তৰ দেখিয়া ধৰ্ম্মপাল বলিলেন, ‘শ্রমণ ধম্মবংশ, আপনি যখন বিশিষ্ট অনুতপ্ত হইয়াছেন, তখন আজ ভিক্ষা সংগ্রহ দ্বারা শ্রমণসেবা করিয়া আপনি তাহার পরিচয় প্রদান করিবেন । ভিক্ষা সংগ্রহে রেবত ভিক্ষু ইহঁার সঙ্গে যাইবেন ।” নুসোম এই কারাগৃহের বাহিরে গিয়া ধরণীর মুখভাবের সহিত আপনার মনোভাবগুলিকে মিলাইয় গুছাইয়া লইবার অবকাশ পাইয়া সন্তুষ্ট হইল। সে প্রফুল্লচিত্তে রেবত ভিক্ষুর সঙ্গে ভিক্ষণসংগ্ৰহাৰ্থ নির্গত হইল । বাহিরে আসিয়া দেখিল, ধরণীর সেই পূৰ্ব্বপরিচিত আলোকদীপ্ত শু্যামশোভা । দেখিল সবই তাহার ধারণার অনুযায়ী আছে, কেবল কে জানে কেমন করিয়া সেই সকল পরিচিতের মধ্য হইতে বিচ্ছিন্ন, বিভিন্ন হইয়া গিয়াছে। সে এক একটা পরিচিত পথ, পরিচিত বিপণি, পরিচিত গৃহ দেখে, আর নিরদিষ্ট বন্ধুসাক্ষাতের মত আনন্দবিহবল হইয়া তাহার চিত্ত সেইদিকে ছুটিয়া যাইতে চাহে। কিন্তু কেবল রেবত ভিক্ষুর প্রজ্জ্বলিত চক্ষু এবং দৃঢ় আজ্ঞাব্যঞ্জক মুখভাব তাঁহাকে নিরস্ত করিয়া রাখিতেছিল। সেও মুণ্ডিতকেশ ও পরিবৰ্ত্তিতবেশে পরিচিত সকলের নিকট গুপ্ত থাকিরা যাইতেছিল। o: অবশেষে যখন তাহারই গৃহপথে চলিতে লাগিল, তখন তাহার হৃদয় স্পন্দিত, শ্বাস সন্ধান হইল * অবশেষে যখন আপনারই গৃহদ্বারে গিয়া ভিক্ষ চাহিতে আদিষ্ট হইল, তখন আনন্দ, সংশয়, কৌতুহল, আশ্বাস, মুক্তির আশা, বিফলতার ভয় প্রভৃতি বিরুদ্ধভাবসংঘাতে চিত্ত উদ্বেল হইয়া উঠিল , সকল ধমনীর রক্ত ঠেলিয়া গিয়া হৃদয়দ্বার ভাঙিয়া ফেলিবার উপক্রম করিল ; পর্যাকুল মস্তিষ্কে সংজ্ঞাহীন হইবার মত হইল। "