পাতা:প্রবাসী (সপ্তম ভাগ, প্রথমাংশ).djvu/৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

&8 একজন প্রৌঢ়া অন্তঃপুরিকা দাড়াইয়া পঞ্জিকা শুনিতেছিল ; “অৰ্থ সত্যযুগোৎপত্তি’র অৰ্দ্ধেক বিবরণ শুনিয়াই সে আপনা আপনি ছোট করিয়া মণিপুরী ভাষায় কহিল যে, এবার বৎসরের রাজসিংহাসন কাহার অধিকৃত হইল এবং না জানি তস্ত মন্ত্রীই বা কে হইলেন । ইহার নিকটবৰ্ত্তী একজন রমণী কিঞ্চিৎ বিরক্তির সহিত তাহাকে থামাইয়া বলিল—“আহ ! আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর, ক্রমে সকল কথাই জানিতে পাইবে।” , কিন্তু সে অপেক্ষা করিতে পারিল না—সকল কাজেই ইহাদের প্রয়োজনের সহিত গুরুতর সম্পর্ক, তাই পঞ্জিকার সত্য-ত্রেতার কথা যদিও তাহার শুনিবার ইচ্ছা ছিল তথাপি কৰ্ম্মের তাড়নায়, ঐ সকল যুগের কথায় কোন নুতনত্ব নাই, এই দোষারোপ করিয়া সে চলিয়া গেল । ক্রমে দৈবজ্ঞ ঠাকুর “অর্থ রাজদ্যোনয়নং” পাঠ করিয়া তাহীদের কার্য্যকারিতার শ্লোক পাঠ করিতে লাগিলেন ; এবং সেই সকল শ্লোকের সরল ব্যাখ্যা শ্রোতৃমণ্ডলীর মুখমণ্ডলকে কখনো হর্ষোৎফুল্ল এবং কখনো ভীতিমান করিয়া তুলিল। তারপর, যাহাদের অদৃষ্ট বর্ষচক্রের চক্রে, সমুদ্রে অথবা গগনে পড়িল, দৈবজ্ঞ ঠাকুরের দ্বারা তাঙ্গদের সেই সকল দোষ দূর করিবার নিমিত্ত বস্ত্র, ছত্র, কুম্ভ, স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র প্রভৃতি দানের ব্যবস্থা হইল। একজন প্রৌঢ়ী রসাতলে ডুবিয়াছিল, তাহার এই দোষের শাস্তির নিমিত্ত দৈবজ্ঞঠাকুর যেমন সোনার নাম করিলেন অমনি প্রৌঢ়া রমণীটি ঠাট্ট করিয়া বলিল—“ঠাকুর, তুমি বড় লোভী ; তোমার লাভের জন্ত সোনার নাম করিতেছ।” অনেকে হাসিয়া উঠিল। বস্তুতঃ এই সকল ব্যবস্থিত দান-ব্যাপার শেষ না হইলে র্তাহাদের কাহারো মনে আর শান্তিশ্ৰী বিরাজ করিতেছে না। আজ অন্তঃপুরের অনেকেই কেহ ভক্তিপ্রণোদিত হইয়া, কেহ বা তাহীদের আচরণ দেখিয়া, দেবতাকে কিছু ন কিছু প্রদান করিয়াছে । কোনো কোনো অন্তঃপুরিকা দেবতার পরমান্ন রাধিবার জন্ত আট আনা পয়সা, তরকারীবাহী চাকরদের হাতে গচ্ছিত করিয়াছে। অন্তঃপুরের নিতান্ত দরিদ্র দাসীও এক সাজি সমঞ্জর তুলসীপত্র ও যথাসম্ভব দক্ষিণা প্রদান করিয়া পুলকিত হইতেছে। কেহ কেহ বা অক্ষমতা প্রযুক্ত আপনাদের মনের মতন উপহার দেবতাকে উৎসর্গ করিতে না পারিয়া বড়ই আক্ষেপ করিল। আর যাহার তুলসীপত্রের সাজিথানি লোকের অভাবে বাহিরে পাঠাইবার সুযোগ পায় নাই, তাহার এবং ভক্তি-নিয়োজিত৷ অন্তঃপুরিকার দল, পুষ্করিণীর দক্ষিণ পারে অবস্থিত ছোট কাকীমার জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রবেশ করিয়া ফুল ও সমঞ্জর তুলসীপত্র ঠাকুরকে সমর্পণ করিল এবং তাহাকে চামর ব্যজন করিয়া প্রসন্নচিত্তে মন্দির পরিত্যাগ করিল। আর এক ছোট কাকীমার স্থাপিত পিত্তলের মহাদেবমূৰ্ত্তিও আজ গো-দুগ্ধে স্নাত হইয়া এইরূপে ভক্তের পুজা গ্রহণ প্রবাসী । [ ৭ম ভাগ । করিলেন,—ইহার সম্মুখে ভূমিসংলগ্ন কলিকা হইতে গঞ্জিকার ধূম উত্থিত হইতে লাগিল । • বারোটার পর অন্তঃপুরের প্রায় সকলেরই আহার শেষ হইয় গেল । অতঃপর—পাকস্থলীর শীতলতা প্রাপ্তির পর, বিবাদ-বিসম্বাদের আর তেমন আশঙ্কাও রহিল না । এইরূপে বৎসরের প্রথম দিন অন্তঃপুরে যথেষ্ট সমাদর লাভ করিল। বিকাল বেলা । পিতামতী মহোদয় তাহার কয়জন বৃদ্ধ পারিষদ লইয়া নুতন পঞ্জিকা শুনিয়া শেষ করিয়াছেন ; এখন তিনি বারানদায় বসিয়া পান চিবাইতেছেন । এমন সময় পিতৃদেব বৈঠকখানা হইতে আসিয়া একখানি সুসজ্জিত ফুলের সাজি মাতৃদেবীকে উৎসর্গ করিয়া তাহার চরণে মস্তক অবলুষ্ঠিত করিলেন, এবং এই প্ৰণামের বিনিময়ে মস্তকে পৃষ্ঠে স্নেহের চুম্বন লাভ করিয়া স্নেহময়ী জননীর পাশ্বে উপবিষ্ট হইলেন। স্নিগ্ধ প্রদোষে মাতাপুত্রের এইরূপ মধুর মিলন অন্তঃপুরের মাধুৰ্য বাড়াইত । যাহা হউক, পিতৃদেব বাহিরে চলিয়া গেলেন । পিতামঙ্গদেবী হাত-পা ধুইয়া অস্তগামী স্বৰ্য্যদেবের উদ্দেশে ও তাহার স্বহস্ত রোপিত তুলসীদেবীর সমীপে বিবিধ শ্লোক আবৃত্তি করিয়া মস্তক অবনত করিলেন । তারপর পুনরায় বারানায় বসিয়া তিনি জয়দেবের রচিত “প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদং” ও “বেদানুদ্ধরতে" প্রভৃতি ভগবানের দশবিধ অবতারের স্তোত্র ভক্তির সঠিত আবৃত্তি করতে লাগিলেন । কিছুক্ষণ বাদে পিতামহদেব এদিকে শুভাগমন করিলেন। আমরা একদল পৌত্র-পৌত্রী তাহকে বরণ করিয়া লইলাম। মাতৃদেবীগণ ও কাকীমাগণ র্তাহাকে প্রণাম করিয়া চলিয়া গেলেন । পিতামহ মহোদয় প্রদীপ ক্ষীণ করিয়া দিয়া আমাদের সহিত গল্প আরম্ভ করিয়া দিলেন । কয়েকটি কথার পর, তিনি তাহার স্বাভাবিক মধুর স্বরকে মধুরতর করিয়া, আমাদের জ্যেষ্ঠ দুইজন খুল্লতাতপুত্রীকে বিশেষরূপ লক্ষ্য করিয়া কৌতুকভরে তাহদের কিশোর স্বদয়ের নবীন প্রেম যে একমাত্র তাহারই প্রাপ্য এতৎ সম্বন্ধে দীর্ঘ গোরচন্দ্রিক সমাপ্ত করিয়া হাস্তোজ্জলমুখে প্রশ্ন করিলেন— “তোমরা কাহাকে ভালবাস ?” বলা বাহুল্য হাস্যময়ী ভগ্নীযুগল পিতামহ মহোদয়কেই বরমাল্য প্রদান করিলেন— র্তাহাদের বাকৃচাতুৰ্য্যের অবধি থাকিল না। ইহাতে পিতামহী মহোদয়া যেন বৃদ্ধবয়সের দাম্পত্য উ হাঁদের দ্বারা শিথিলীকৃত হইবার সম্ভাবনার সপত্নীবিদ্বেষের ভাণ করিয়াউ হাদিগকে কিছু কঠোর বচন শুনাইয়া দিলেন। পিতামহীদেবীর এই আপাতদৃষ্টিতে কপট ক্রোধের অন্তরালে কোন প্রকৃত ক্রোধের ছায়৷ লুক্কায়িত ছিল কি না কে.জানে ? ইহার পর পিতামহ মহোদয় যেন বড়ই আমোদ পাইলেন—তিনি হাসিয়া অস্থির হইলেন।