পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চন্দ্রশেখর চতুর্থ পরিচ্ছেদ কাদে জ্যোৎস্ব ফুটিয়াছে । গঙ্গার দুই পাশ্বে বহুদূর বিস্তৃত বালুকাময় চর । চন্দ্ৰকরে সিকতা শ্রেণী অধিকতর ধবল ঐ ধরিয়াছে ; গঙ্গার জল চন্দ্র করে প্রগাঢ়তর নীলিম প্রাপ্ত হইয়াছে । গঙ্গার জল ঘন নীল--তটারূঢ় বনরাজি ঘনশ্যাম, উপরে আকাশ রত্নখচিভ নীল। এরূপ সময়ে বিস্তৃতিজ্ঞানে কখনও কখনও মন চঞ্চল হইয় উঠে। নদী অনন্ত, যতদূর দেখিতেছি, নদীর অন্ত দেখিতেছি না, মানবাদৃষ্ঠের ন্যায় অস্পষ্টদৃষ্ট ভবিষ্যতে মিশাইয়াছে । নীচে নদী অনন্ত ; পাশ্বে বালুকাভূমি অনন্ত ; তীরে বৃক্ষশ্রেণী অনস্ত ; উপরে আকাশ অনস্ত । তন্মধ্যে তারক। মালা অনস্তসংখ্যক । এমন সময়ে কেন মনুষ্য আপনাকে গণনা করে ? এই যে নদীর উপকূলে যে বালুকাভূমে তরুণীশ্রেণী বাধা রহিয়াছে, তাহার বালুকাকণার অপেক্ষ মনুষ্যের গৌরব কি ? এই তরণী-শ্রেণীর মধ্যে একখানি বড় বজর আছে —তাহার উপরে সিপাহীর পাহার। } সিপাহাদয় গঠিত মূৰ্ত্তির ন্যায় বন্দুক স্বন্ধে করির স্থির দাড়াইয়। রহিয়াছে। ভিতরে স্নিগ্ধ ফাটিক-দীপের আলোকে নানাবিধ মহাঘ্য আসন, শষ্য, চিত্র, পুন্তল প্রভৃতি শোভা পাইতেছে । ভিতরে কয় জল সাহেব ! তুষ্ট জনে সতরঞ্চ খেলিতেছেন : এক জন স্বরাপান করিতেছেন ও পড়িতেছেন । এক জন বাদ্যবাদন করিতেছেন । অকস্মাং সকলে চমকিয়া উঠিলেন। সেই নৈশ নীরবতা বিদীর্ণ করিয়া, সহসা বিকট ক্রনদনধ্বনি উথিত হইল । আমিয়ট সাহেব জনসনকে কিস্তি দিতে দিতে বলিলেন, “ও কি ও ?” জনৃসন বলিলেন, “কার কিস্তি মাত হইয়াছে।" ক্ৰন্দন বিকটতর হইল। ধ্বনি বিকট নহে, কিন্তু সেই জলভূমির নীরব প্রান্তরমধ্যে এই নিশীথক্রন্দন বিকট শুনাইতে লাগিল । '-আমিয়ট খেলা ফেলিয়া উঠিলেন। বাহিরে আসিয়া চারিদিক্‌ দেখিলেন । কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না । দেখিলেন, নিকটে কোথাও শ্মশান নাই । সৈকতভূমির মধ্যভাগ হইতে শুদ আসিতেছে । আমিয়ট নৌকা হইতে অবতরণ করিলেন, ধ্বনির অমুসরণ করিয়া চলিলেন । কিয়দর গমন করিয়া S}(t দেখিলেন, সেই বালুকাপ্রান্তরমধ্যে একাকী কেহ বসিয়া আছে । আমিয়ট নিকটে গেলেন । স্ত্রীলোক উচ্চৈঃস্বরে র্কাদিতেছে । আমিয়ট হিন্দী ভাল জানিতেন না । স্ত্রীলোককে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে তুমি ? কেন কাদিতেছ?” স্ত্রীলোকটি তাহার হিন্দী কিছুই বুঝিতে পারিল না, কেবল উচ্চৈঃস্বরে কাদিতে লাগিল। আমিয়ট পুনঃ পুনঃ তাহার কথায় কোন উত্তর ন! পাইয়। হস্তেঙ্গিতের দ্বারা তাহাকে সঙ্গে আসিতে বলিলেন । রমণী উঠিল । আমিয়ট অগ্রসর হইলেন । রমণী তাহার সঙ্গে সঙ্গে কাদিতে কঁাদিতে চলিল । এ আর কেহ নহে— পাপিষ্ঠ। শৈবলিনী । দেখিলেন, একটি পঞ্চম পরিচ্ছেদ হাঁসে বজরার ভিতরে আসিয়া অমিয়ট গল্‌ষ্টনকে বলিলেন, “এই স্ত্রীলোক একাকিনী চরে বসিয়া কঁাদিতেছিল । ও আমার কথা বুঝে না, আমি উহার কথা বুঝি না। তুমি উহাকে জিজ্ঞাস কর।” গলুষ্টন্‌ও প্রায় আমিয়টের মত পণ্ডিত ; কিন্তু ইংরেজমহলে হিন্দীতে তাহার বড় পসার। গল্‌ষ্টন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে তুমি ?” শৈবলিনী কথ। কহিল ন—কাদিতে লাগিল । গ । কেন কঁাদিতেছ ? শৈবলিনী তথাপি কথা কহিল না,—কাদিতে লাগিল । গ ! তোমার বাড়ী কোথায় ? শৈবলিনী পূৰ্ব্ববত । গ ! তুমি এখানে কেন আসিয়াছ ? শৈবলিনী তদ্রুপ । গল্‌ষ্টন্‌ হারি মানিলেন । কোন কথার উত্তর দিল না দেখিয়া ইংরেজের শৈবলিনীকে বিদায় দিলেন । শৈবলিনী সে কথাও বুঝিল না—নড়িল না—দাড়াইয়া রহিল । আমিয়ট বলিলেন, “এ আমাদিগের কথা বুঝে না—আমরা উহার কথা বুঝি না । পোষাক দেখিয়৷ বোধ হইতেছে, ও বাঙ্গালীর মেয়ে । এক জন বাঙ্গালীকে ডাকিয়া উহাকে জিজ্ঞাসা করিতে বল ।” সাহেবের খানসামারা প্রায় সকলেই বাঙ্গালী মুসলমান। আমিয়ট তাহাদিগের এক জনকে ডাকিয়া কথা কহিতে বলিলেন ।