পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিধান করিয়া, পূৰ্ব্ববস্ত্র পরিত্যাগ করিয়৷ জিজ্ঞাসা করিল, “আর কি করিব ?” উত্তর । তোমার শ্বশুরালয় কোথায় ? শৈ । বেদগ্ৰাম । সেখানে কি ষইতে হইবে ? উত্তর । হা, গিয়া গ্রামপ্রান্তে পর্ণকুটীর নিৰ্ম্মাণ করিবে । শৈ । আর ? উত্তর। ভূতলে শয়ন করিবে । শৈ । আর ? উত্তর । ফলমূল পত্র ভিন্ন ভোজন করিবে না । একবার ভিন্ন খাইবে না । শৈ । আর ? উত্তর । জটাপারণ করিবে । শৈ । আর ? উত্তর । একবীরমাত্র দিনাস্তে থামে ভিক্ষার্থে প্রবেশ করিলে ভিক্ষাকালে গামে থামে আপনার পাপ কীৰ্ত্তন করিবে । শৈ । আমার পাপ সে বলিল ।র নয় ! কি প্রায়শ্চিত্ত নাই ? অfর উত্তর । অ!ছে ! শৈ। কি ? উত্তর । মরণ ! শৈ। কত গ্রহণ করিলাম--আপনি কে ? শৈবলিনা কোন উত্তর পাইল ন৷ তখন শৈবলিনী সকতরে পুনশ্চ জিজ্ঞাস করিল, “আপনি ষেই হউন, জানিঙে ঢাহি ন । পৰ্ব্বত্তের দেবতা মনে করিয়! আমি আপনাকে প্রণাম করিতেছি । আপনি আর একটি কথার উদ্ভব করুন, অামার স্বামী কোথায় ?" উত্তর ! কেন ? গৈ । আর কি তাহার দর্শন পাইব না ? উত্তর ! তোমার প্রস্শ্চিন্তু সমাপ্ত হইলে পাইবে । শৈ। দ্বাদশ বৎসর পরে ? উত্তর । দ্বাদশ বৎসর পরে । শৈ । এ প্রায়শ্চিন্ত গ্রহণ করিয়া কত দিন বঁচিব ? যদি দ্বাদশ বৎসর মধ্যে মরিয়া যাই ? .উত্তর। তবে মৃত্যুকালে সাক্ষাৎ পাইবে । শৈ। কোন উপায়ে কি তৎপূৰ্ব্বে সাক্ষাং পাইব ন ? আপনি দেবতা, অবশু জানেন । উত্তর । যদি এখন তাহাকে দেখিতে চাও, তবে সপ্তাহকাল দিবারাত্র এই গুহামধ্যে একাকিনী বাস কর । এই সপ্তাহ, দিনরাত কেবল স্বামীকে মনোমধ্যে চিন্তা কর—অদ্য কোন চিন্তাকে মনোমধ্যে স্থান 8& দিও না । এই সাত দিন কেবল একবার সন্ধ্যাকালে নির্গত হইয় ফলমূলাহরণ করিও ; তাহাতে পরি তোষজনক ভোজন করিও নী—যেন ক্ষুধানিবারণ ন হয় । কোন মনুষ্যের নিকট মাইও না বা কাহারও সহিত সাক্ষাৎ হইলেও কথা কহিও না। যদি এই অন্ধকার গুহায় সপ্তাহ অবস্থিতি করিয়া সরলচিত্তে অবিরত অনন্তমন হইয়া কেবল স্বামীর ধ্যান কর, তবে তাহার সাক্ষাৎ পাইবে । তৃতীয় পরিচ্ছেদ বাতাস উঠিল শৈবলিনা তাহাই করিল--সপ্তদিবস গুহ হইতে বাহির হইল না—কেবল একবার দিনাস্তে ফলমুলান্বেষণে বাহির হইত। সাত দিন মনুষ্যের সঙ্গে আলাপ করিল না । প্রায় অনশনে সেই বিকটান্ধকারে আনন্তেন্দ্রিয়বৃত্তি হইয়। স্বামীর চিন্তা করিতে লাগিল— কিছু দেখিতে পায় না, কিছু শুনিতে পায় না, কিছু স্পর্শ করিতে পায় ন! : ইন্দ্রির নিরুদ্ধ—মন নিরুদ্ধ— সৰ্ব্বত্র স্বামী স্বামী চিত্তবৃত্তিসমূহের একমাত্র অবলম্বন হইল । অন্ধকারে আর কিছু দেখিতে পায় না— সাত দিন সাত রাত কেবল স্বামীমুখ দেখিল । ভীম নারবে তার কিছু শুনিতে পায় না—কেবল স্বামীর জ্ঞানপরিপূর্ণ, স্নেহবিচলিত বাক্যালাপ শুনিতে পাইল –প্ৰাণেন্দ্রিসু কেবলমাত্র তাহার পুষ্পপাত্রের পুষ্পরাশির গন্ধ পাচতে লাগিল—ত্বক্ কেবল চন্দ্রশেখরের আদরের স্পর্শ অনুভূত করিতে লাগিল । আশা আর কিছুতে নাই—আর কিছুতে ছিল ন, স্বামিসন্দর্শন-কামনাতেই রহিল । স্মৃতি কেবল শ্মশ্রশোভিত, প্রশস্তললাটপ্রমুখ বদলমণ্ডলের চতু পাশ্বে ঘুরিতে লাগিল—কণ্টক ছিন্নপক্ষ ভ্রমরী যেমন প্লভ সুগন্ধিপুষ্পবৃক্ষতলে কষ্টে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়, তেমনই ঘুরিয়৷ বেড়াইতে লাগিল । যে এ বতের পরামর্শ দিয়াছিল, সে মনুষ্যচিত্তের সর্বাংশদশী, সন্দেহ নাই । নির্জন, নীরব অন্ধকার, মনুষ্যসন্দর্শনরহিত, তাহাতে আবার শরীর ক্লিষ্ট, ক্ষুধাপীড়িত, চিত্ত অন্নচিন্তাশূন্ত ; এমন সময়ে যে বিষয়ে চিত্ত স্থির করা যায়, তাহাই জপ করিতে করিতে চিন্ত তন্ময় হইয়া উঠে । এই অবস্থায় অবসন্ন-শরীরে, অবসন্ন-মনে, একাগ্রচিত্তে স্বামীর ধান করিতে করিতে শৈবলিনী বিকৃতিপ্রাপ্ত হইয়। উঠিল । বিকৃতি ? না দিব্য চক্ষু ? শৈবলিনী দেখিল— অস্তরের ভিতর অন্তর হইতে দিব্য চক্ষু চাছিয়।