পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

'o পঞ্চম পরিচ্ছেদ সেই বনমধ্যে এক প্রকাণ্ড ভূমিখণ্ডে ভগ্নশিলাখণ্ডসকলে পরিবেষ্টিত হইয়া একটি বড় মঠ আছে । পুরাণতত্ত্ববিদেরা দেখিলে বলিতে পারিতেন, ইহ। পূৰ্ব্বকালে বৌদ্ধদিগের বিহার ছিল—তার পরে ‘হিন্দুর মঠ হইয়াছে, অট্টালিকাশ্রেণী দ্বিতল—মধ্যে বহুবিধ দেবমন্দির এবং সম্মুখে নাটমন্দির ; সকলই প্রায় প্রাচীরে বেষ্টিত, আর বহিঃস্থিত বহুবৃক্ষশ্রেণী দ্বারা এরূপ আচ্ছন্ন যে, দিনমানে অনতিদূর হইতেও কেহ বুঝিতে পারে না যে, এখানে কোঠা আছে। অট্টালিক। -সকল অনেক স্থানেই ভগ্ন, কিন্তু দিনমানে দেখা যায় যে, সে সকল স্থান সম্প্রতি মেরামত হইয়াছে । দেখিলেই জানা যায় যে, এই গভীর দুর্ভেদ্য অরণ্যমধ্যে মনুষ্য বাস করে । এই মঠের একটি কুঠার মধ্যে একটা বড় কুঁদে জলিতেছিল, তাহার ভিতর কল্যাণী প্রথম চৈতন্য হইলে দেখিলেন, সম্মুখে সেই শুভ্ৰশরীর শুভ্ৰবসন মহাপুরুষ । কল্যাণী বিস্মিতলোচনে আবার চাহিতে লাগিলেন, এখনও স্মৃতি পুনরাগমন করিতে ছিল না । তখন মহাপুরুষ বলিলেন, “ম : দেবতার ঠাই, শঙ্কা করিও না । একটু ঢুপ আছে তুমি খাও, তার পর তোমার সহিত কথা কহিব ।” কল্যাণী প্রথমে কিছুই বুঝিতে পাপ্লিলেন না, তার পর ক্রমে ক্রমে মনের কিছু স্থৈর্য হইলে গলায় আঁচল দিয়া সেই মাহাত্মাকে একটি প্রণাম করিলেন । তিনি সুমঙ্গল আশীৰ্ব্বাদ করিয়! গৃহান্তর হইতে একটি সুগন্ধ মৃৎপাত্র বাহির করিয়৷ সেই দলস্ত অগ্নিতে দুগ্ধ উত্তপ্ত করিলেন । দুগ্ধ তপ্ত হইলে কল্যাণীকে তাহ। দিয়া বলিলেন, “মা ! কন্যাকে কিছু খাওয়াও, আপনি কিছু খাও, তাহার পর কথ। কহিবে ।" কল্যাণী হৃষ্টচিত্তে কন্যাকে দুগ্ধপান করাষ্টতে আরম্ভ করিলেন । তখন সেই পুরুষ “আমি যতক্ষণ ন! আসি কোন চিস্তা করিও না 7 বলিয়া মন্দির হইতে বাহিরে গেলেন । বাহির হইতে কিয়ংকাল পরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন যে, কল্যাণী কন্যাকে দুধ খাওয়ান সমাপন করিয়াছেন বটে, কিন্তু আপনি কিছু খান নাই, দুগ্ধ যেমন ছিল, প্রায় তেমনই আছে, অতি অল্পই ব্যয় হইয়াছে । সেই পুরুষ তখন বলিলেন, “ম!! তুমি দুধ খাও নাই, আমি আবার বাহিরে যাইতেছি, তুমি দুধ ন খাইলে ফিরিব ম৷ ” সেই ঋষিতুল্য পুরুষ এই বলিয়। বাহিরে যাইতেছিলেন, কল্যাণী আবার তাহাকে প্রণাম করিয়া যোড়হাত করিলেন । बइिबष्क्रप्टछन्न Gहांदली ,বনবাসী বলিলেন, “কি বলিবে ?” তখন কল্যাণী বলিলেন, “আমাকে দুধ খাইতে আজ্ঞা করিবেন না—কোন বাধা আছে । আমি খাইব না ।" তখন বনবাসী অতি করণস্বরে বলিলেন, “কি বাধা আছে, আমাকে বল, আমি বনবাসী ব্রহ্মচারী, তুমি আমার কন্যা, তোমার এমন কি কথা আছে যে, আমাকে বলিবে না ? আমি যখন বন হইতে তোমাকে অজ্ঞান অবস্থায় তুলিয়া আনি, তৎকালে তোমাকে অত্যন্ত ক্ষুৎপিপাসাপীড়িত বোধ হইয়াছিল, - তুমি ন খাইলে বাচিবে কি প্রকারে ?" কল্যাণী তখন গলদশ্রলোচনে বলিলেন “আপনি দেবতা, আপনাকে বলিব—আমার স্বামী এ পর্য্যন্ত অভুক্ত আছেন, ভাস্কার সাক্ষাং ন পাইলে কিম্ব। ভোজন-সংবাদ ন৷ শুনিলে আমি কি প্রকারে খাইব ?" ব্রহ্মচারী জিজ্ঞাস করিলেন, “তোমার স্বামী কোথায় ?" 鄒 কল্যাণী বলিলেন, “তাহা আমি জানি না—তিনি দুধের সন্ধানে বাহির হইলে পর দস্থার। আমাকে চুরি করিয়া লইয়। আসিয়াছে।" তখন ব্রহ্মচারী একটি একটি করিয়। প্রশ্ন করিয়৷ কল্যাণী এবং তাঙ্গার স্বামীর রস্তান্ত সমুদায় অবগত হইলেন । কল্যাণী স্বামীর নাম বলিলেন ন!, বলিতে পারেন না, কিন্তু আর আর পরিচয়ের পরে বঙ্গ৮:রা বুঝিলেন । জিজ্ঞাস করিলেন, “তুমিষ্ট মহেন্দ্রের পত্নী ?" কল্যাণী নিরুত্তর হইয়া যে অগ্নিতে দুগ্ধ তপ্ত হইয়াছিল, অবনতমুখে তাহাতে কাষ্ঠ প্রদান করিলেন, তখন ব্রহ্মচারী বলিলেন, “তুমি আমার বাক পালন কর, দুগ্ধ পান কর, আমি তোমার স্বামার সংবাদ আনিতেছি । তুমি দুধ ন খাইলে আমি যাইব ন৷ ” কল্যাণী বলিলেন, “একটু জল এখানে আছে কি ?" ব্রহ্মচারী জলকলস দেখাইয়। দিলেন । কল্যাণী অঞ্জলি পাতিলেন, ব্রহ্মচারী অঞ্জলি পূরিয়া জল ঢালিয়া দিলেন । কল্যাণী সেই জলাঞ্জলি ব্রহ্মচারীর পদমূলে লইয়। গিয়া বলিলেন, “আপনি ইহাতে পদরেণু দিন " ব্রহ্মচারী অঙ্গুষ্ঠের দ্বারা জল স্পর্শ করিলে কল্যাণী সেই জলাঞ্জলি পান করিলেন এবং বলিলেন, “আমি অমৃত পান করিয়াছি—আর কিছু খাইতে বলিবেন না --স্বামীর সংবাদ ন পাইলে আর কিছু খাইব না।” ব্রহ্মচারী তখন বলিলেন, “তুমি নিৰ্ভয়ে এই দেউলমধ্যে অবস্থিতি কর, আমি তোমার স্বামীর সন্ধানে চলিলাম।”