পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আনন্দমঠ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ রাত্রি অনেক । চাদ মাথার উপর । পূর্ণচন্দ্র নহে, আলো তত প্রখর নহে ৷ এক অতি বিস্তীর্ণ প্রাস্তরের উপর সেই অন্ধকারের ছায়াবিশিষ্ট অস্পষ্ট আলো পড়িয়াছে । সে আলোতে মাঠের এপার ওপার দেখা যাইতেছে না । মাঠে কি আছে, কে অাছে, দেখা যাইতেছে না । মাঠ যেন অনন্ত জনশূন্ত, ভরের আবাসস্থান বলিয়া বোধ হইতেছে । সেট মাঠ দিয়া মুরশিদাবাদ ও কলিকাত। যাইবার রাস্ত । রাস্তার ধারে একটি ক্ষুদ্র পাহাড়। পাহাড়ের উপর অনেক অস্ত্ৰিাদি বৃক্ষ । গাছের মাথ! সকল চাদের আলোতে উজ্জ্বল হইয়। সরু সবু করিয়া কঁাপিতেছে, তাহার ছায়। কালোপাথরের উপর কালে৷ হইয়। তরতর করিয়৷ কঁাপিতেছে । ব্রহ্মচারী সেই পাহাড়ের শিখরের উপর উঠিয় দাড়াইয়। স্তব্ধ হইয়। শুনিতে লাগিলেন, ~~কি শুনিতে লাগিলেন, বলিতে পারি না । সেই অনস্ততুল্য প্রাস্তরেও কোন শব্দ নাই--কেবল বৃক্ষাদির ময়ের দে ৷ এক স্থানে পাহাড়ের মূলের নিকটে বড় জঙ্গল ! উপরে পাতাড়, নীচে রাজপথ, মধ্যে সেই জঙ্গল । সেখানে কি শব্দ হইল, বলিতে পারি না - রক্ষচরী সেই দিকে গেলেন । নিবিড় জঙ্গলমপে প্রবেশ করিলেন ; দেখিলেন, সেই বনমধ্যে বৃক্ষরাজির অন্ধকার তলদেশে সরি সারি গাছের নীচে মানুষ বসিয়া আছে । মানুষ সকল দীর্ঘাকার, কৃষ্ণকায় সশস্ত্র : বিটপবিচ্ছেদ নিপতিত জ্যোংস্নায় তাহাদের মার্জিত আয়ুধু সকল জ্বলিতেছে । এমন গুই শত লোক বসিয়৷ আছে-একটি কথাও কহিতেছে না । ব্রহ্মচারী ধীরে ধীরে তাহাদিগের মধ্যে গিয়া কি একটা ইঙ্গিত করিলেন-কেহ উঠিল না, কেহ কথা কহিল না, কেহ কোন শব্দ করিল না ; তিনি সকলের সম্মুখ দিয়া সকলকে দেখিতে দেখিতে গেলেন, অন্ধকারে মুখপানে চাহিয়া নিরীক্ষণ করিতে করিতে গেলেন, যেন কাহাকে খুজিতেছেন পাইতেছেন না । খুজিয়া খুজিয়া এক জনকে চিনিয় তাহার অঙ্গস্পর্শ করিয়া ইঙ্গিত করিলেন । ইঙ্গিত করিতেই সে উঠিল । ব্রহ্মচারী তাহাকে লইয়া দূরে অসিয়া দাড়াইলেন ; এই ব্যক্তি সুবাপুরুষ—ঘনকৃষ্ণ গুম্ফশ্মশ্রতে তাহার চন্দ্ৰবদন আবৃত—সে বলিষ্ঠকায়, অতি সুন্দর পুরুষ । সে গৈরিক বসন পরিধান করিয়াছে—সৰ্ব্বাঙ্গে চন্দনশোভা । ব্রহ্মচারী তাহাকে বলিলেন, “ভবানন্দ, মহেন্দ্র সিংহের কোন সংবাদ রাখ ?” Y S

  • & ভবানন্দ তখন বলিলেন, "মহেন্দ্র সিংহ আজ প্রাতে । স্ত্রী-কন্ত। লইয়। গৃহত্যাগ করিয়া ষাইতেছিল, চটিতে—” এই পর্য্যন্ত বলাতে ব্ৰহ্মচারী বলিলেন, “চটিতৃে যাহা ঘটিয়াছে, তাহ জানি । কে করিল ?” - ভব। । গেয়ো চtযালোক বোধ হয় ৷ এখন সকল গ্রামের চাষাভূযো পেটের জালায় ডাকাত , হইয়াছে । আজকাল কে ডাকাত নয় ? আমরা আজ লুঠিয়া খাইয়াছি—কোতওয়াল সাহেবের দুই মণ চাউল যাইতেছিল—তাহা গ্রহণ করিয়া বৈষ্ণবের ভোগে লাগাইয়াছি ।

ব্রহ্মচারী হাসিয়া বলিলেন, “চো<ের হাত হতে আমি তাহার স্ত্রী-কন্যাকে উদ্ধার করিয়াছি। এখন তাহাদিগকে মঠে রাখিন। আসিয়াছি ! এখন তোমার উপর ভার যে, মহেন্দ্রকে খুজিয়। তাহার স্ত্রী-কন্যা তাহার জিন্ম। করিয়া দাও । এখানে জীবানন্দ থাকিলে কার্যোদ্ধার হইবে ।” ভব।নন্দ স্বীকত হইলেন । স্থানান্তরে গেলেন । ব্রহ্মচারী তখন সপ্তম পরিচ্ছেদ চটিতে বসিয়া ভাবিয়া কোন ফলোদয় হইবে না, বিবেচনা করিয়া মহেন্দ গাত্রোথান করিলেন । নগরে গিয় রাজপুরুষদিগের সহায়তায় স্ত্রী-কন্যার অনুসন্ধান করিবেন এই বিবেচনায় সেই দিকেই চলিলেন । কিছু দূর গিয়া পথিমধ্যে দেখিলেন, কতকগুলি গোরুর গাড়ী ঘেরিয়া অনেকগুলি সিপাহী চলিয়াছে । ১১৭৬ সালে বাঙ্গালী প্রদেশ ইংরেজের শাসনাধীন হয় নাই । ইংরেজ তখন বাঙ্গালার দেওয়ান । তাহার খাজনার টাক। আদায় করিয়া লন, কিন্তু তখনও বাঙ্গালীর প্রাণ, সম্পত্তি প্রভৃতি রক্ষণাবেক্ষণের কোন ভার লয়েন নাই । তখন টাকা লইবার ভার ইংরেজের, আর প্রাণ, সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের ভার পাপিষ্ঠ, নরাধম, বিশ্বাসহস্তা, মনুষ্যকুলকলঙ্ক মীরজাফরের উপর । মীরজাফর আত্মরক্ষায় অক্ষম, বাঙ্গালা রক্ষা করিবে কি প্রকারে ? মীরজাফর গুলী খায় ও ঘুমায় । ইংরেজ টাক আদায় করে ও ডেসপ্যাচ লেখে । বাঙ্গালী কঁাদে আর উৎসন্ন ষায় ! অতএব বাঙ্গালার কর ইংরেজের প্রাপ্য। কিন্তু শাসনের ভার নবাবের উপর । যেখানে যেখানে ইংরেজেরা আপনাদের প্রাপ্য কর আপনার আদায় করিতেন, সেখানে তাহারা এক এক কালেক্টর নিযুক্ত করিয়াছিলেন । কিন্তু খাজান আদায় হইয়া কলিকাতায় যায়। লোক না খাইয়া মরুক,