পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ஆ. দেখিলেন ; সেই অমল নীলান্ত গগনরূপী সমুদ্র মনে পড়িল ৷ কপালকুণ্ডলা পূৰ্ব্বস্তৃতি সমালোচনায় অন্তমন হইয়৷ চলিলেন । অন্যমনে যাইতে যাইতে কোথায় কি উদ্দেশ্যে যাইতেছিলেন, কপালকুণ্ডলা তাহ ভাবিলেন না । ষে পথে যাইতেছিলেন, তাহী ক্রমে অগম্য হইয়া আসিল ; বন নিবিড়তর হইল ; শিরোপরে বৃক্ষশাখাবিন্যাসে চন্দ্রালোক প্রায় একেবারে রুদ্ধ হইয়। আসিল ; ক্রমে আর পথ দেখা যায় না । পথের অলক্ষ্যতায় প্রথমে কপালকুণ্ডল চিন্তামগ্নত হইতে উথিত হইলেন । ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন, এই নিবিড় বনমধ্যে আলো জ্বলিতেছে। লুৎফউন্নিসা পূৰ্ব্বে এই আলে৷ দেখিয়াছিলেন। কপালকুণ্ডল৷ পূৰ্ব্বাভ্যাসফলে এ সকল সময়ে ভয়হীন অ’চি কৌতুহলময়ী । ধীরে ধীরে সেই দীপজ্যোতির অভিমুখে গেলেন । দেখিলেন, যথায় আলে৷ জলিতেছে, তথায় কেহ নাই কিন্তু তাহার অনতিদূরে বননিবিড়ত হেতু দূর হইতে অদৃষ্ঠ একটি ভগ্ন গৃহ আছে । গৃহটি ইষ্টকনিৰ্ম্মিত, কিন্তু অতি ক্ষুদ্র, অতি সামান্য ; তাহাতে একটি মাত্র ঘর। সেই ঘর হইতে মনুষ্যকথোপকথনশব্দ নির্গম হইতেছিল । কপালকুণ্ডল নিঃশব্দপদক্ষেপ গৃহসমিধানে গেলেন । গৃহের নিকটবৰ্ত্তী হইবামাত্র বোধ হইল, তই জন মনুস্থ্য সাবধানে কথোপকথন করিতেছে । প্রথমে কথোপকথন কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। পরে ক্রমে চেষ্টাজনিত কর্ণের তাঙ্গুত৷ জন্মিলে, নিম্নলিখিত মত কথা শুনিতে পাইলেন । এক জন কহিতেছে, “আমার অভীষ্ট মৃত্যু, ইহাতে তোমার অভিমত না হয়, আমি তোমার সাহায্য করিব না ; তুমিও আমার সহায়তা করিও না ।" অপর ব্যক্তি কহিল, “আমিও মঙ্গলাকাজক্ষী নহি ; কিন্তু যাবজ্জীবন জন্য ইহার নিৰ্ব্বাসন হয়, তাহাতে আমি সন্মত আছি । কিন্তু হত্যার কোন উদ্যোগ আমা হইতে হইবে না ; বরং তাহার প্রতিকুলতাচরণ করিব।” প্রথমালাপকারী কহিল, “তুমি অতি অবোধ, অজ্ঞ ন । তোমায় কিছু জ্ঞানদান করিতেছি। মনঃসংযোগ করিয়৷ শ্রবণ কর । অতি গুঢ় বৃত্তান্ত বলিব । চতুর্দিকু একবার দেখিয়া আইস, যেন মমুন্যশ্বাস শুনিতে পাইতেছি ।” বাস্তবিক কপালকুণ্ডলা কথোপকথন উত্তমরূপে শুনিবার জন্ত কক্ষ-প্রাচীরের অতি নিকটে আসিয়া বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী দাড়াইয়াছিলেন এবং তাহার আগ্রহাতিশয় ও শঙ্কার কারণে ঘন ঘন গুরুত্থাস বহিতেছিল । সমভিব্যাহারীর কথায় গৃহমধ্যস্থ এক ব্যক্তি বাহিরে আসিলেন এবং আসিয়াই কপালকুণ্ডলাকে দেখিতে পাইলেন। কপালকুণ্ডলাও পরিষ্কার চন্দ্রীলোকে আগন্তুক পুরুষের অবয়ব সুস্পষ্ট করিয়া দেখিলেন। দেখিয়া ভীত হইবেন, কি প্রফুল্লিতা হইবেন, তাহ স্থির করিতে পারিলেন না। দেখিলেন, আগন্তুক ব্রাহ্মণবেশী ; সমান্ত ধুতি পরিধান ; গাত্র উত্তরীয়ে উত্তমরূপে আচ্ছাদিত । ব্রাহ্মণকুমার অতি কোমলবয়স্ক ; মুখমণ্ডলে বয়শ্চিহ্ন কিছুমাত্র নাই । মুখখনি পরম সুন্দর, সুন্দরী রমণীমুখের স্তায় সুন্দর, কিন্তু রমণীদুল্লভ তেজোগৰ্ব্ববিশিষ্ট । র্তাহারকেশগুলি সচরাচর পুরুষদিগের কেশের দ্যায় ক্ষৌরকার্য্যবিশেষাত্মক মাত্র নহে, স্ত্রীলোকদিগের ন্যান্স অচ্ছিল্লাবস্থায় উত্তরীয় প্রচ্ছন্ন করিয়া পৃষ্ঠদেশে, অংসে, বাহুদেশে, কদাচিৎ বক্ষে সংসপিত হইয়া পড়িয়াছে । ললাট প্রশস্ত, ঈষৎ স্ফীত, মধ্যস্থলে একমাত্র শিরাপ্রকাশশোভিত । চক্ষু দুটি বিছাত্তেজ:পরিপূর্ণ । কোষশূন্য এক দীর্ঘ তরবারি হস্তে ছিল। কিন্তু এ রূপরাশিমধ্যে এক ভীষণ ভাব ব্যক্ত হইতেছিল। হেমকাও বণে খেন কোন করাল কামনার ছায় পড়িয়াছিল । অস্তস্তল পর্য্যস্ত অন্বেষণক্ষম কটাক্ষ দেখিয়া কপালকুণ্ডলার ভাতিসঞ্চার হইল । উভয়ে উভয়ের প্রতি ক্ষণকাল চাহিয়া রহিলেন । প্রথমে কপালকুণ্ডলা নয়নপল্লব নিক্ষিপ্ত করিলেন । কপালকুণ্ডল নয়ন-পল্লব নিক্ষিপ্ত করাতে আগন্তুক তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে ?” যদি এক বৎসর পূৰ্ব্বে হিজলীর কিয়াবনে কপালকুণ্ডলার প্রতি এ প্রশ্ন হইত, তবে তিনি তৎক্ষণেই সঙ্গত উত্তর দিতেন । কিন্তু এখন কপালকুণ্ডলা কতকদূর গৃহরমণীর স্বভাবসম্পন্ন হইয়াছিলেন, সুতরাং সহসা উত্তর করিতে পারিলেন না । ব্রাহ্মণবেশী কপালকুণ্ডলাকে নিরুত্তর দেখিয়া গাম্ভীর্য্যের সহিত কহিলেন, “কপালকুণ্ডলা ! তুমি রাত্রে এ নিবিড় বনমধ্যে কি জন্ত আসিয়াছ ?” অজ্ঞাত রাত্রিচর পুরুষের মুখে আপন নাম শুনিয়া কপালকুণ্ডল অবাকৃ হইলেন, কিছু ভীতাও হইলেন । সুতরাং সহসা কোন উত্তর তাহার মুখ হইতে বাহির হইল না । ব্রাহ্মণবেশী পুনৰ্ব্বার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি আমাদিগের কথাবার্তা শুনিয়াছ ?”