পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/২০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

> 8 মরিয়াছিল, সেইদিন অবধি প্রফুল্লের বাড়ীতে ফুলমণি প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আসিয়া শোয় । তবে ফুলমণি কি চরিত্রের লোক, তাহা ছেলেমানুষ প্রফুল্ল সবিশেষ জানিত না । ফুলমণি প্রফুল্ল অপেক্ষ। বয়সে দশ বছরের বড় ; দেখিতে শুনিতে মন্দ নয়, বেশভূষায় একটু পরিপাট্য রাখিত। একে ইতর জাতির মেয়ে, তাতে বালবিধবা, চরিত্রটা বড় সে খাটি রাখিতে পারে নাই । গ্রামের জমিদার পরাণ চৌধুরী। তাহার এক জন গোমস্ত দুর্লভ চক্রবর্তী ঐ গ্রামে আসিয়৷ মধ্যে মধ্যে কাছারী করিত । লোকে বলিত, ফুলমণি ফুলভের বিশেষ অনুগৃহীতা । অথবা দুলভই তাহার অনুগৃহীত। এ সকল কথা প্রফুল একেবারে যে কখন শুনে নাই—ত নয়, কিন্তু কি করে —আর কেহ আপনার ঘরদ্বার ফেলিয়া প্রকুল্লের কাছে আসিয়া শুইতে চাহে না । বিশেষ প্রফুল মনে করিল, “সে মন্দ হোকৃ, আমি না মন্দ হইলে, আমায় কে মন্দ করিবে ?” অতএব ফুলমণি দুই চারি দিন আসিয়া প্রফুল্লের ঘরে শুইল । শ্রাদ্ধের পরদিন ফুলমণি একটু দেরী করিয়া আসিতেছিল । পথে একটা আমগাছের তলায় একটা বন আছে, আসিবার সময় ফুলমণি সেই বনে প্রবেশ করিল । সেই বনের ভিতর এক জন পুরুষ দাড়াইয়া ছিল । বলা বাহুল্য যে, সে এই দুৰ্লভচন্দ্র । চক্ৰবৰ্ত্তী মহাশয় কৃতাভিসারা তাম্বলরাগরক্তাধরা, রাঙ্গাপেড়ে সাড়াপরা, হাসিতে মুখভরা ফুলমণিকে দেখিয়া বলিল, “কেমন, আজ ?" ফুলমণি বলিল, “হা, আজই বেশ । তুমি রাত্রি দুপুরের সময় পান্ধী নিয়ে এসো-ছয়ারে টোকা মেরে, আমি দুয়ার খুলিয়া দিব, কিন্তু দেখো, গোল ন৷ হয় ।” দুর্লভ । করবে না ? ফুলমণি । তার একটা ব্যবস্থা করতে হবে । আমি আস্তে আস্তে দোরটি খুলব, তুমি আস্তে আস্তে সে ঘুমিয়ে থাকৃতে থাকৃতে তার মুখটি কাপড় দিয়া চাপিয়া বাধিয়। ফেলিবে । তার পর চেচায় কার বাপের সাধ্য ? দুলভ। তা আমন জোর ক’রে নিয়ে গেলে কয় দিন থাকিবে ? ফুল। একবার নিয়ে যেতে পারলেই হলো । যার তিন কুলে কেউ নাই, যে অন্নের কাঙ্গাল, সে খেতে পাবে, কাপড় পাবে, গয়না পাবে, টাকা পাবে, সোহাগ তার ভয় নাই । কিন্তু সে ত গোল বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী পাবে—সে আবার থাকৃবে না ? সে ভার অামার— আমি যেন গয়নাটাকার ভাগ পাই । এইরূপ কথাবৰ্ত্ত সমাপ্ত হইলে দুর্লভ স্বস্থানে গেল। ফুলমণি প্রফুল্লের কাছে গেল। প্রফুল্ল এ সৰ্ব্বনাশের কিছুই জানিতে পারে নাই ; সে মা'র কথা ভাবিতে ভাবিতে শয়ন করিল ; মা’র জন্ত যেমন রোজ কাদে, তেমনি কাদিল ; কাদিয়া যেমন রোজ ঘুমায়, তেমনই ঘুমাইল । দুই প্রহরে দুর্লভ আসিয়া দ্বারে টোকা মারিল, ফুলমণি দ্বার খুলিল । দুর্লভ প্রফুল্লের মুখ বাধিয়া ধরাধরি করিয়া পান্ধীতে তুলিল। বাহকের নিঃশব্দে তাহাকে পরাণবাবু জমীদারের বিহার-মন্দিরে লইয়া চলিল। বলা বাহুল্য, ফুলমণি সঙ্গে সঙ্গে চলিল । ইহার অৰ্দ্ধদও পরে ব্রজেশ্বর সেই শৃঙ্গগুহে প্রফুল্লের সন্ধানে আসিয়া উপস্থিত হইল । ব্রজেশ্বর সকলকে লুকাইয়। রাত্রে পলাইয়। আসিয়াছে। হায় ! কোথাও কেহ নাই ! প্রফুল্লকে লইয়া বাহকের নিঃশব্দে চলিল, বলিয়াছি ; কেহ মনে না করেন, এটা ভ্রমপ্রমাদ । বাহকের প্রকৃতি শব্দ করা, কিন্তু এবার শব্দ করার পক্ষে তাহাদের প্রতি নিষেধ ছিল । শব্দ করিলে গোলযোগ হইবে । তা ছাড়া আর একটা কথা ছিল । ব্ৰহ্মঠাকুরাণীর মুখে শুনা গিয়াছে, বড় ডাকাতের ভয়, বাস্তবিক এরূপ ভয়ানক দক্ষ্যভীতি কখন কোন দেশে হইয়াছিল কি না সন্দেহ । তখন দেশ অরাজক । মুসলমানের রাজ্য গিয়াছে ; ইংরেজের রাজ্য ভাল করিয়া পত্তন হয় নাই—হইতেছে মাত্র। তাতে আবার বছর কত হইল, ছিয়াত্তরের মন্বস্তর দেশ. ছারখার করিয়৷ গিয়াছে । তার পর আবার দেবীসিংহের ইজারা । পৃথিবীর ওপরে ওয়েষ্টমিনিষ্টর হলে দাড়াইয়া এদমণ্ড বর্ক সেই দেবীসিংহকে অমর করিয়া গিয়াছেন। পৰ্ব্বতোগণ অগ্নিশিখাবৎ জ্বালাময় বাক্যস্রোতে বর্ক, দেবীসিংহের কুৰ্ব্বিষহ অত্যাচার অনন্তকালসমীপে পাঠাইয়াছেন । র্তাহাব নিজমুখে সে দৈববাণীতুল্য বাক্যপরম্পরা শুনিয়া শোকে অনেক স্ত্রীলোক মূচ্ছিত হইয়া পড়িয়াছিল— আজিও শত বৎসর পরে সেই বক্তৃতা পড়িতে গেলে শরীর রোমাঞ্চিত এবং হৃদয় উন্মত্ত হয়। সেই ভয়ানক অত্যাচার বরেন্দ্রভূমি ডুবাইয়া দিয়াছিল। অনেকেই কেবল খাইতে পায় না নয়, গৃহে পৰ্য্যস্ত বাস করিতে পায় না। যাহাদের খাইবার নাই,* তাহারা পরের কাড়িয়া খায়। কাজেই এখন গ্রামে গ্রামে দলে দলে চোর-ডাকাত। কাহার সাধ্য শাসন করে ? গুডল্যাড সাহেব রঙ্গপুরের প্রথম কালেক্টর ।