পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/২১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨8 গৃহে আমার আশ্রয় দিলেন। আমি তাহার কন্য, তিনি আমার পিতা । তিনিও আমাকে এক প্রকার সম্প্রদান করিয়াছেন । প্র । এক প্রকার কি ? বয়স্তা । সৰ্ব্বস্ব শ্ৰীকৃষ্ণে । প্র । সে কি রকম ? বয়স্তা। রূপ, যৌবন, প্রাণ । প্র । তিনিই তোমার স্বামী ? বয়স্তা । হা-কেন না, যিনি সম্পূর্ণরূপে অামাতে অধিকারী, তিনিই আমার স্বামী । প্রফুল্ল দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল, “বলিতে পারি না। কখন স্বামী দেখ নাই, তাই বলিতেছ— স্বামী দেখিলে কখন শ্ৰীকৃষ্ণে মন উঠিত না ।” মুৰ্থ ব্রজেশ্বর এভ জানিত না । বয়স্ত। বলিল, “শ্ৰীকৃষ্ণে সকল মেয়েরই মন উঠিতে পারে, কেন না, তার রূপ অলস্ত, যৌবন অনন্ত, ঐশ্বৰ্য্য অনন্ত, গুণ অনও " এ যুবতী ভবানী ঠাকুরের চেলা, কিন্তু প্রফুল্ল নিরক্ষর—এ কথার উত্তর দিতে পারিল না । হিন্দুধৰ্ম্ম প্রণেতার উত্তর জানিতেন । ঈশ্বর অনস্ত জানি । কিন্তু অনন্তকে ক্ষুদ্র হৃদয়-পিঞ্জরে পূরিতে পারি না । সান্তকে পারি। তাই অনন্ত জগদীশ্বর, হিন্দুর হৃৎপিঞ্জরে সাপ্ত শ্ৰীকৃষ্ণ স্বামী তারও পরিষ্কাররূপে সাস্ত। এই জন্য প্রেম পবিত্র হইলে স্বামী, ঈশ্বরে আরোহণের প্রথম সোপান । তাই হিন্দুর মেয়ের পতিই দেবতা । অন্ত সব সমাজ হিন্দুসমাজের কাছে এ অংশে নিকৃষ্ট । প্রফুল্ল মুখ মেয়ে, কিছু বুঝিতে পারিল না। বলিল, “আমি অত কথা ভাই, বুঝিতে পারি না । তোমার নামটি কি, এখনও ত বলিলে না ?” বয়স্ত বলিল, “ভবানী ঠাকুর নাম রাখিয়াছেন নিশি ; আমি দিবার বহিন নিশি । দিবাকে এক দিন আলাপ করিতে লইয়। আসিব । কিন্তু যা বলিতেছিলাম, শোন । ঈশ্বরই পরম স্বামী । স্ত্রীলোকের পতিই দেবতা, শ্ৰীকৃষ্ণ সকলের দেবতা । দুটো দেবতা কেন, ভাই ? তই ঈশ্বর ? এ ক্ষুদ্র প্রাণের ক্ষুদ্র ভক্তিটুকুকে দুই ভাগ করিলে কতটুকু থাকে ?” প্র। দূর ! মেয়েমানুষের ভক্তির কি শেষ আছে ? : নিশি। মেয়েমানুষের ভালবাসার শেষ নাই । ভক্তি এক, ভালবাসা আর । . . o বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী ۰ي %8٩% ه লইলেন না, বরং আরও কিছু দিলেন। আপনার প্র । আমি - তা আজও জানিতে পারি নাই । অামার দুই নুতন । প্রফুল্লের চক্ষু দিয়া ঝর ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। নিশি বলিল, “বুঝিয়াছি বোন—তুমি অনেক দুঃখ পাইয়াছ ।” তখন নিশি প্রফুল্লের গলা জড়াইয়া ধরিয়া তার চক্ষের জল মুছাইল । বলিল, “এত জানিতাম না ।” নিশি তখন বুঝিল, ঈশ্বরভক্তির প্রথম সোপান পতিভক্তি । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ যে রাত্রে দুলভ চক্রবর্তী প্রফুল্লকে তাহার মাতার বাড়ী হইতে ধরিয়া লইয়া যায়, দৈবগতিকে ব্ৰজেশ্বর সেই রাত্রেই প্রফুল্পের বাসস্থানে দুর্গাপুরে গিয়৷ উপস্থিত হইয়াছিলেন । ব্ৰজেশ্বরের একটি ঘোড় ছিল, ঘোড়ায় চড়িতে বজেশ্বর খুব মজবুত । যখন বাড়ীর সকলে ঘুমাইল, ব্রজেশ্বর গোপনে সেই অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া অন্ধকারে দুর্গাপুরে প্রস্থান করিলেন। যখন তিনি প্রফুল্লের কুটীরে উপস্থিত হইলেন, তখন সে ভবন জনশূন্ত, অন্ধকারমর ! প্রফুল্লকে দমাতে লইয়া গিয়াছে ৷ সেই রাত্রে ব্ৰজেশ্বর পাড়া পড়সী কাহাকেও পাইলেন না যে, জিজ্ঞাস করেন। ব্ৰজেশ্বর প্রফুল্লকে না দেখিতে পাইয়া মনে করিল যে, প্রফুল্ল এক থাকিতে ন পারিয়া কোন কুটুম্ববাড়ী গিয়াছে। ব্ৰজেশ্বর অপেক্ষা করিতে পারিল না । বাপের ভয়ে, রাত্রিমধ্যেই ফিরিয়া আসিল। তার পর কিছু দিন গেল। হরবল্লভের সংসার যেমন চলিতেছিল—তেমনই চলিতে লাগিল । সকলে খায় দায় বেড়ায়, সংসারের কাজ করে । ব্রজেশ্বরের দিন কেবল ঠিক সে রকম ষায় না । হঠাৎ কেহ কিছু বুঝিল না—জানিল না । প্রথমে মা জানিল । গৃহিণী দেখিল, ছেলের পাতে দুধের বাটিতে দুধ পড়িয়া থাকে,মাছের মুড়ার কেবল কণ্ঠার মাছটাই ভুক্ত হয়, “রান্না ভাল হয় নাই বলিয়া ব্রজ ব্যঞ্জন ঠেলিয়া রাখে ৷ মা মনে করিলেন, "ছেলের মন্দাগি হইয়াছে ' প্রথমে জারক লেবু প্রভৃতি টোটুকার ব্যবস্থা করিলেন, তার পর কবিরাজ ডাকিবার কথা হইল। ব্রজ হাসিয়া উড়াইয়া দিল । মাকে ব্রজ হাসিয়া উড়াইয়া দিল, কিন্তু ব্ৰহ্মঠাকুরাণীকে পারিল না । বুড়ী ব্রজেশ্বরকে এক দিন এক পাইয়া চাপিয়া ধরিল । “ছ রে ব্রজ, তুই আর নয়ানবউয়ের মুখ দেখিস না কেন ?”