পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/২৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দেবী চৌধুরাণী ব্ৰ। আমার এ টাকার নিতান্ত. প্রয়োজন পড়িয়াছে—বোধ হয় চুরি-ডাকাইতি করিয়াও যদি আমি এ টাকা সংগ্ৰহ করি, তাহ হইলেও অধৰ্ম্ম হয় লী, কেন না, এ টাকা নহিলে আমার বাপের জাতিরক্ষা হয় না। আমি এ টাকা লইব । কিন্তু কবে পরিশোধ করিতে হইবে ? দেবী । দেবতার সম্পত্তি, দেবতা পাইলেই হইল। আমার মৃত্যুসংবাদ শুনিলে পর, ঐ টাকার আসল আর এক মোহর সুদ দেবসেবায় ব্যয় করিবেন। ব্র । সে অামারই ব্যয় করা হইবে । সে আপনাকে ফাকি দেওয়া হইবে । আমি ইহাতে স্বীকৃত নহি । দেবী । আপনার যেরূপ ইচ্ছা, সেইরূপে পরিশোধ করিবেন। ত্র । আমার টাকা জুটিলে আপনাকে পাঠাইয়। দিব । দেবী । আপনার লোক কেহ আমার কাছে আসিবে না, আসিতে পরিবে না । ব্র । আমি নিজে টাকা লইয়া আসিব । দেবী কোথায় আসিবেন ? আমি এক স্থানে থাকি না । ব্র । যেখানে বলিয়া দিবেন । দেবী। দিন ঠিক করিয়া বলিলে, আমি স্থান ঠিক করিয়া বলিতে পারি। ত্র । আমি মাঘ-ফাল্গুনে টাকা সংগ্ৰহ করিতে পারিব। কিন্তু একটু বেশী করিয়া সমন্ব’লওয়া ভাল । বৈশাখ মাসে টাকা দিব । দেবী । তবে বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমীর রাত্রে এই ঘাটেই টাকা আনিবেন । সপ্তমীর চন্দ্রাস্ত পৰ্য্যস্ত আমি এইখানে থাকিব । সপ্তমীর চন্দ্রাস্তের পর আসিলে আমার দেখা পাইবেন না । ব্ৰজেশ্বর স্বীকৃত হইল । তখন দেবী পরিচারিকাদিগকে আজ্ঞা দিলেন, মোহরের ঘড়া ছিপে উঠাইয়া দিয়া আইস পরিচারিকার ঘড়া ছিপে লইয়া গেল ; ব্ৰজেশ্বরও দেবীকে আশীৰ্ব্বাদ করিয়া ছিপে যাইতেছিল, তখন দেবী নিষেধ করিয়া বলিল, “আর একটা কথা বাকী আছে । এ ত কর্জ দিলাম—মৰ্য্যাদা দিলাম কই ?” ° ব্ৰ । কলসীটা মৰ্য্যাদা । দেবী। আপনার যোগ্য মৰ্য্যাদা নহে। যথা সাধ্য মৰ্য্যাদা রাখিব । এই বলিয়। দেবী আপনার আঙ্গুল হইতে একটা আঙ্গটি খুলিল ৷ ব্ৰজেশ্বর তাহা গ্রহণ করিবার জন্য সহাস্তবদনে হাত পাতিল । দেবী হাতের উপর 용) আঙ্গটি ফেলিয়া দিল না—ব্রজেশ্বরের হাতখানি ধরিল--আপনি আঙ্গটা পরাইয়া দিবে। ব্ৰজেশ্বর জিতেন্দ্রির, কিন্তু মনের ভিতর কি একটা গোলমাল হইয়া গেল, জিতেন্দ্রিয় ব্রজেশ্বর তাহা বুঝিতে পারিল না। শরীরে কাটা দিল—ভিতরে যেন অমৃতস্রোভ ছুটিল । জিতেন্দ্রিয় ব্রজেশ্বর, হাতটা সরাইয়া লইতে ভুলিয়া গেল । বিধাতা এক এক সময়ে এমনই বাদ সাধেন যে, সময়ে আপন কাজ ভুলিয়া যাইতে হয় । তা, দেবী সেই মানসিক গোলযোগের সময়ে ব্ৰজেশ্বরের আঙ্গুলে ধীরে ধীরে আঙ্গটি পরাইতে লাগিল । সেই সময়ে ফোটা দুই তপ্ত জল ব্রজেশ্বরের হাতের উপর পড়িল ৷ ব্ৰজেশ্বর দেখিল, দেবীর মুখ চোখের জলে ভাসিয়া যাইতেছে । কি রকমে কি হইল, বলিতে পারি না, ব্রজেশ্বর ত জিতেন্দ্রিয় –কিন্তু মনের ভিতর কি একটা গোল বাধিয়াছিল । সেই অার একখানা মুখ মনে পড়িল—বুঝি, সে মুখে সেই রাত্রে এমনই অশ্রধারা বহিয়াছিল । সে চোখের জল-মোছানটাও বুঝি মনে পড়িল । এই সেই, সেই এই, কি এমনই একটা কি গোলমাল বাধিয়া গেল । ব্ৰজেশ্বর কিছু না বুঝিয়।--কেন জানি না-দেবীর কাধে হাত রাখিল, অপর হাত ধরিয়া মুখখানি তুলিয়। ধরিল—বুঝি মুখখানা প্রফুল্লের মত দেখিল। বিবশ, বিহ্বল হইয়া সেই অশ্র-নিষিক্ত বিস্বাধরে—আ ছি ছি ! ব্রজেশ্বর ! আবার ! তখন ব্রজেশ্বরের মাথায় যেন আকাশ ভাঙ্গিয়৷ পড়িল । কি করিলাম ! এ কি প্রফুল্ল ? সে যে দশ বৎসর মরিয়াছে! ব্রজেশ্বর উৰ্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিয়া, একেবারে ছিপে গিয়া উঠিল । সাগরকে সঙ্গে লইয়াও গেল না । সাগর “ধর । ধর । আসামী পালায় !” বলিয়া পিছু পিছু ছুটিয়া গিয়া ছিপে উঠিল। ছিপ খুলিয়া ব্রজেশ্বরকে ও ব্রজেশ্বরের দুই রত্নাধার—একটি সাগর, আর একটি কলসী—ব্রজেশ্বরের নৌকায় পৌছাইয়। দিল । এ দিকে নিশি আসিয়া দেবীর শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখিল, দেবী নৌকার তক্তার উপর লুটাইয়া পড়িয়া কাদিতেছে। নিশি তাহাকে উঠাইয়া বসাইল —চোখের জল মুছাইয়া দিল—মুস্থির করিল। তখন নিশি বলিল, “এই কি মা, তোমার নিষ্কাম ধৰ্ম্ম ? এই কি সন্ন্যাস ? ভগবদ্বাক্য কোথায় মা এখন ? দেবী চুপ করিয়া রহিল। নিশি বলিল, “ও সকল ব্ৰত মেয়েমানুষের নহে। যদি মেয়েকে ও পথে যেতে হয়, তবে আমার মভ হইতে হইবে । আমাকে