পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আনন্দমঠ - কিছু ক্ষীণ প্রবাহ অনুভব করিলেন। তখন আরও পত্ররস নিষেক করিতে লাগিলেন, ক্রমে নিশ্বাস প্রখরতর বহিতে লাগিল। নাড়ীতে হাত দিয়ী ভব|নন্দ দেখিলেন, নাড়ীর গতি হইয়াছে। শেষে অল্পে অল্পে পূৰ্ব্বদিকের প্রথম প্রভাতরাগবিকাশের ন্যায়, প্রভতপদ্মের প্রথমোন্মেষের ন্যায়, প্রথম প্রেমানুভবের ন্যায়, কল্যাণী চক্ষুরুন্মীলন করিতে লাগিলেন । দেখিয়া ভবানন্দ সেই অৰ্দ্ধজীবিত দেহ অশ্বপৃষ্ঠে তুলিয়। দ্রুত বেগে অশ্ব চালাইয়। নগরে গেলেন । অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ সন্ধা না হইতেই সন্তান-সম্প্রদায় সকলে জানিতে পারিয়াছিলেন যে, সত্যানন্দ বহ্মচারী আর মহেন্দ্র দুষ্ট জনে বন্দী হুইয়া নগরের কারাগারে আবদ্ধ আছেন । তখন একে একে, দুয়ে কুয়ে, দশে দশে, শতে শতে, সন্তান সম্প্রদায় আসিয়া সেই দেবালয়বেষ্টনকারী অরণ্য পরিপূর্ণ করিতে লাগিলেন । সকলেই সশস্ত্র । নয়নে রোযাগ্নি, মুখে দম্ভ, অপরে প্রতিজ্ঞ । প্রথমে শত, পরে সহস্ৰ, পরে দ্বিসহস্র এইরূপে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। তখন মঠের দ্বারে দাড়াইয়! : তরবারি-হস্তে জ্ঞানানন্দ উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “আমর। অনেক দিন হইতে মনে করিয়াছি যে, এই বাবুয়ের বাসা ভাঙ্গিয়া, এই যবনপুরা ছারখার করিয়া নদীর জলে ফেলিয়। দিব । এই শূয়োরের গোয়াড় আগুনে পোড়াইয়া মাত বসুমতীকে আবার পবিত্র করিব। ভাই, আজ সেই দিন আসিয়াছে । আমাদের গুরুর গুরু পরমগুরু, ষিনি অনন্তজ্ঞানময়, সৰ্ব্বদ। শুদ্ধাচার, যিনি লোকহিতৈষী, যিনি দেশহিতৈষী, যিনি সনাতন ধৰ্ম্মের পুনঃ প্রচার জন্য শরীরপাতন প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন—ঘাহাকে বিষ্ণুর অবতার স্বরূপ মনে করি, যিনি আমাদের মুক্তির উপায়, তিনি আজ মুসলমানের কারাগারে বন্দী। আমাদের তরবারিতে কি ধার নাই ?” হস্তপ্রসারণ করিয়া জ্ঞানানন্দ বলিলেন,—“এ বাহুতে কি বল নাই?” বক্ষে করাঘাত করিয়া বলিলেন, “এ হৃদয়ে কি সাহস নাই ?— ভাই, ডাক, হরে মুরারে মধুকৈটভারে —যিনি মধু কৈটভ বিনাশ করিয়াছেন, মিনি হিরণ্যকশিপু, কংস, দস্তবক্র, শিশুপাল প্রভৃতি দুর্জয় অসুরগণের নিধন সাধন করিয়াছেন, র্যাহার চক্রের ঘর্ঘরনির্ঘোষে মৃতুঞ্জয় শভূও ভীত হইয়াছিলেন–যিনি অজেয়, রণে জয়দাতা, আমরা তার উপাসক, র্তার বলে আমাদের 潑 ૨. તેજ বাহুতে অত্যন্ত বল—তিনি ইচ্ছাময়, ইচ্ছা করিলেই আমাদের রণজয় হইবে । চল, আমরা সেই যবনপুরী ভাঙ্গিয়৷ ধূলিগুড়ি করি। সেই শূকরনিবাস অগ্নিসংস্কৃত করিয়া নদীর জলে ফেলিয়া দিই। সে বাবু য়ের বাস ভাঙ্গিয় খড়কুট বাতাসে উড়াইয়। দিই। বল, হরে মুরারে মধুকৈটভারে !" তখন সেই কানন হইতে অভিভাষণ নাদে সহস্র-কণ্ঠে একেবারে শব্দ হইল, “হরে মুরারে মধুকৈটভারে!” সহস্র অসি একেবারে ঝনৎকার শব্দ করিল। সহস্ৰ বল্লম ফলক সহিত উৰ্দ্ধে উত্থিত হইল । সহস্র বাহুর আস্ফোটে বজ্ৰনিনাদ হইতে লাগিল । সহস্ৰ ঢোল যোদ্ধৃবর্গের কর্কশ পৃষ্ঠে তড়তড় শব্দ করিতে লাগিল ৷ তমহাকোলাহলে পশুসকল ভীত হইয়া কানন হইতে পলাইল । পক্ষিসকল ভয়ে উচ্চরব করিয়া গগনে উঠয়। গগন আচ্ছন্ন কবিল সেঈ সময় শত শত জয়ঢক্ক। একেবারে নিনাদিত হইল-তখন“হরে মুরারে মধুকৈটভারে !" বলিয়া কানন হইতে শ্রেণীবদ্ধ সন্তানের দল নির্গত হইতে লাগিল । ধীরগম্ভীর পদবিক্ষেপে মুখে উচ্চৈঃস্বরে হরিনাম করিতে করিতে তাহার। সেই অন্ধকার রাত্রে নগর অভিমুখে । চলিল ৷ বস্ত্রের মৰ্ম্মর শব্দ, অস্ত্রের ঝনঝন শব্দ, কণ্ঠের অন্মুটনিনাদ, মধ্যে মধ্যে তুমুলরবে হরিবোল। ধীরে, গম্ভীরে, সরোযে, সতেজে সেই সস্তানবাহিনী নগরে আসিয়া নগর বিত্রস্ত করিয়৷ ফেলিল। অকস্মাৎ এই বজ্রাঘাত দেখিয়৷ নাগরিকের কে কোথায় পলাইল, তাহার ঠিকানা নাই । নগররক্ষকেরা হতবুদ্ধি হইয়। নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিল । এ দিকে সন্তানের প্রথমেই রাজকারাগারে গিয়া কারাগার ভাঙ্গিয়া, রক্ষিবর্গকে মারিয়া ফেলিল এবং সত্যানন্দ ও মহেন্দ্রকে মুক্ত করিয়া মস্তকে তুলিয়৷ নৃত্যু আরম্ভ করিল। তখন অতিশয় হরিবোলের গোলযোগ পড়িয়া গেল। সত্যানন্দ ও মহেন্দ্রকে মুক্ত করিয়াই তাহার। যেখানে মুসল । মানের গৃহ দেখিল, আগুন ধরাইয়। দিল । তখন সত্যানন্দ বলিলেন, “ফিরিয়া চল, অনর্থক অনিষ্টসাধনে প্রয়োজন নাই।" সস্তানদিগের এই সকল দৌরাত্ম্যের সংবাদ পাইয়। দেশের কর্তৃপক্ষগণ র্তাহাদিগের দমনার্থ এক দল পরগণা-সিপাহী পাঠাইলেন । তাহাদের কেবল বন্দুক ছিল, এমন নহে, একটা কামানও ছিল । সন্তানেরা তাহীদের আগমন সংবাদ পাইয়া, আনন্দকানন হইতে নির্গত হইয়া যুদ্ধার্থ অগ্রসর হইলেন। কিন্তু লাঠি, সড়কি বা বিশ পচিশটা বন্দুক কামানের কাছে কি করিবে ? সন্তানগণ পরাজিত হইয়া পলায়ন করিতে লাগিল ।