পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আনন্দমঠ হইল। বিধৰ্ম্মীর দল পলাইল । মার মার শব্দে জীবানন্দ, ধীরানন্দ বিধৰ্ম্মী সেনার পশ্চাতে ধাবমান হইলেন। তাহাদের তোপ সন্তানেরা কাড়িয়া লইল, বহুতর ইংরেজ ও সিপাহী নিহত হইল । সৰ্ব্বনাশ হইল দেখিয়া কাপ্তেন হে ও ওয়াটসন ভবানন্দের নিকট বলিয়। পাঠাইল, “তামরা সকলে তোমাদিগের নিকট বন্দী হইতেছি, আর প্রাণিহত্যা করিও না ।” জীবানন্দ ভবানন্দের মুখপনে চাহিলেন । ভবানন্দ মনে মনে বলিলেন, “ত হুইবে না, আমায় যে আজ মরিতে হইবে ।” তখন ভবানন্দ উচ্চৈঃস্বরে হস্তেত্তোলন করিয়া হরিবোল দিয়া বলিলেন, “মার মার!” আর এক প্রাণী বঁচিল না—শেষ এক স্থানে ২০।৩০ জন গোর সৈন্য একত্রিত হইয়। আত্মসমর্পণে কৃতনিশ্চয় হইল, অতি ঘোরতর রণ করিতে লাগিল । জীবানন্দ বলিলেন, “ভবানন্দ, আমাদের রণজয় হষ্টয়াছে, আর কী নাই, এই কয় জন ব্যতীত আর কেহ জীবি ত নাই, উল্লাদিগকে প্রাণদান দিয়৷ চল, আমরা ফিরিয়৷ যাই ।” ভবানন্দ বলিলেন, “এক জন জীবিত থাকিতে ভবানন্দ ফিরিবে না—জীবাননী, তোমার দিব্য দিয়া বলিতেছি যে, তুমি তফাতে দাড়া ইয়া দেখ, এক। আমি এই কয় জন ইংরেজকে নিহত করি ।” কাপ্তেন টমাস অশ্বপৃষ্ঠে নিবদ্ধ ছিল। ভবানন্দ আজ্ঞা দিলেন, “উতাকে আমার সম্মুখে রাখ, আগে ঐ বেটা মরিবে, তবে ত আমি মরিব ।” কাপ্তেন টমাস বাঙ্গালা বুঝিত, বুঝিয়া ইংরেজ সেনাকে বলিল, “ইংরেজ ! আমি তে। মরিয়াছি, প্রাচীন ইংলণ্ডের নাম তোমরা রক্ষা করিও, তোম} দিগকে পৃষ্টের দিব্য দিতেছি, আগে আমাকে মার, তার পর এই বিদ্রোহীদিগক মার ।” ভো করিয়া একটি বুলেট ছুটিল, এক জন আইরিসম্যান কাপ্তেন টমাসকে লক্ষ্য করিয়া বন্দুক ছুড়িয়াছিল । ললাটে বিদ্ধ হইয়। কাপ্তেন টমাস প্রাণত্যাগ করিল । ভবানন্দ তখন ডাকিয়া বলিলেন, “আমার ব্রহ্মাস্ত্র ব্যর্থ হইয়াছে, কে এমন পার্থ বৃকোদর নকুল সহদেব আছে যে, এ সময় আমায় রক্ষা করিবে ? দেখ, বাণাহত ব্যান্ত্রের দ্যায় গোরা আমার উপর ঝুঁকিভেছে । আমি মরিবার জন্ত আসিয়াছি, আমার সঙ্গে মরিতে চাও, এমন সস্তান কেহ আছ ?” আগে ধীরানন্দ অগ্রসর হইল, পিছে জীবানন্দ– সঙ্গে আর ১০১৫৷২০৫০ জন সস্তান আসিল । ভবানন্দ ধারানন্দকে দেখিয়া বলিল, “তুমিও কি আমদের সঙ্গে মরিতে আসিলে ?" tt | ধীর । "কেন, মরা কি কাহারও ইজার মহল না কি ?" এই বলিতে বলিতে ধীরানন্দ এক জন গোরাকে আহত করিল। ভব । তা নয় । কিন্তু মরিলে ত স্ত্রী-পুত্রের মুখাবলোকন করিয়া দিনপাত করিতে পারিবে না । ধীর। কালিকার কথা বলিতেছ? এখনও বুঝ নাই ? ( ধীরানন্দ আহত গোরাকে বধ করিলেন ।) ভব । ন—( এই সময়ে এক জন গোরার আঘাতে ভবানন্দের দক্ষিণ বাহু ছিন্ন হইল । ) ধীর । আমার সাধ্য কি যে, তোমার ন্যায় পবিত্ৰাত্মাকে সে সকল কথ। বলি ? অামি সত্যা নন্দের প্রেরিত চর হইয়া গিয়াছিলাম । ভব । সে কি ? মহারাজের আমীর প্রতি আবিশ্বাস ? ( ভবাননা তখন এক হাতে সদ্ধ করিতেছিলেন । ) ধীর নন্দ ভঁাহাকে রক্ষা করিতে করিতে বলিলেন “কল্যাণীর সঙ্গে তোমার যে সকল কথা হইয়াছিল, তাহ। তিনি স্বকৰ্ণে শুনিয়াছিলেন ।” ভব। কি প্রকারে ? ধীর। তিনি স্বয়ং সেইখানে ছিলেন । সাবধান থাকিও । ( ভবানন্দ এক জন গোর কর্তৃক আহত হইয়। ভtহাকে প্রত্যাহত করিলেন ) তিনি কল্যাণীকে গীতা পড়াইতেছিলেন, এমন সময় তুমি আসিলে । সাবধান ! ( ভবানন্দের বাম বাহু ছিন্ন হইল । ) ভব । আমার মৃত্যুসংবাদ তাহাকে দিও। : বলিও, আমি অবিশ্বাসী নহি । ধীরানন্দ বাষ্পপূর্ণলোচনে যুদ্ধ করিতে করিতে বলিলেন, “তাহা তিনি জানেন । কালি রাত্রের আশীবৰ্বাদ-বাক্য মনে কর । আর আমাকে বলিয়া দিয়াছেন, ‘ভবানন্দের কাছে থাকিও, আজ সে মরিবে । মৃত্যুকালে তাহাকে বলিও, আমি আশীৰ্ব্বাদ করিতেছি, পরলোকে তাহার বৈকুণ্ঠ প্রাপ্তি হইবে ।” ভবানন্দ বলিলেন, “সস্তানের জয় হউক, ভাই ! আমার মৃত্যুকালে একবার ‘বন্দে মাতরম শুনাও দেখি ” তখন ধারাননের আজ্ঞানুক্রমে যুদ্ধোন্মত্ত সকল সন্তান মহাতেজে “বন্দে মাতরম্ গায়িল। তাহাতে তাহাদিগের বাহুতে দ্বিগুণ বলসঞ্চার হইয়! উঠিল । সেই ভয়ঙ্কর মুহূৰ্ত্তে অবশিষ্ট গোরাগণ নিহত হইল। রণক্ষেত্রে আর শব্দ রহিল না । সেই মুহূৰ্বে ভবানন্দ মুখে “বন্দে মাতরম্ গায়িতে গায়িতে, মনে বিষ্ণুপদ ধান করিতে করিতে প্রাণত্যাগ করিলেন । - -