পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চন্দ্রশেখর শৈ। বলিব । তোমার জিজ্ঞাসায় প্রয়োজন নাই, অমনি বলিতেছি । সাহেবের সঙ্গে আমার এ পর্য্যস্ত সাক্ষাৎ হয় নাই । আমাকে গ্রহণ করিলে আমার স্বামী ধৰ্ম্মে পতিত হইবেন না। সু । তবে তোমার স্বামী যে তোমাকে গ্রহণ করবেন, তাহাতে সন্দেহ করিও না । তিনি ধৰ্ম্মাত্মা, অধৰ্ম্ম করিবেন না, তবে তার মিছা কথায় সময় নষ্ট করিও না । শৈবলিনী একটু নীরব হইয়া. রহিল। একটু কাদিল, চক্ষের জল মুছিয়। বলিল, “আমি যাইব – আমার স্বামীও আমায় গ্ৰহণ করিবেন, কিন্তু আমার কলঙ্ক কি কখনও ঘুচিবে ?" সুন্দরী কোন উত্তর করিল না । শৈবলিনী বলিতে লাগিল, “ইহার পর পাড়ার ছোট মেয়েগুলা আমাকে আমুল দিয়া দেখাইয়। বলিবে কি না যে, ‘ঐ, উহাকে ইংরেজে লইয়া গিয়াছিল ! ঈশ্বর ন৷ করুন, কিন্তু যদি কখন আমার পুত্রসস্তান হয়, তবে তাহার অন্নপ্রাশনে নিমন্ত্ৰণ করিলে কে আমার বাড়ী খাইতে আসিবে ? যদি কখন কন্যা হয়, তবে তাহার সঙ্গে কোন সুব্রাহ্মণ পুত্রের বিবাহ দিবে ? আমি যে স্বধৰ্ম্মে আছি, এখন ফিরিয়া গেলে কেই ব| তাহা বিশ্বাস করিবে ? আমি ঘরে ফিরিয়া গিয়া কি প্রকারে মুখ দেখাইব ?" সুন্দরী বলিল, “সহ অদৃষ্ঠে ছিল, তাই ঘটিয়াছে —সে ত আর কিছুতেই ফিরিবে না । কিছু ক্লেশ চিরকালই ভোগ করিতে হইবে । তথাপি আপনার ঘরে থাকিব । শৈ । কি সুখে ? কোন সংখর আশায় এত কষ্ট সহ্য করিবার জন্য ঘরে ফিরিয়৷ বাইব ? ন পি তl, ন মাতা, ন বন্ধু স্থ । কেন, স্বামী ? এ নারাজন্ম আর কাহার জন্ত ? শৈ । সব ত জান -- ভূ । জানি । জানি যে, পৃথিবীতে যত পাপিষ্ঠ। আছে, তোমার মত পাপিষ্ঠ। কেহ নাই । যে স্বামীর মত স্বামী জগতে দুর্লভ, তাহার স্বেঙ্গে তোমার মন উঠে না । কি না বালকে যেমন খেলাঘরের পুতুলকে আদর করে, তিনি স্ত্রীকে সেরূপ আদর করিতে জানেন ন । কি না বিধাতা তাকে সং গড়িয়া রাঙ্গত দিয়া সাজান নাই-মানুষ করিয়াছেন । তিনি ধৰ্ম্মাত্মা, পণ্ডিত ; তুমি পাপিষ্ঠী—তাকে তোমার মনে ধরিবে কেন ? তুমি অন্ধের অধিক অন্ধ, তাই বুঝিতে পার না যে, তোমার স্বামী তোমায় যেরূপ ల ভালবাসেন, নারীজন্মে সেরূপ ভালবাসা স্থলভ— অনেক পুণ্যফলে এমন স্বামীর কাছে তুমি এমন ভালবাসা পেয়েছিলে । তা যাক, সে সব কথা দূর হোকৃ—এখনকার সে কথা নয় । তিনি নাই ভালবাসুন, তবু তার চরণসেবা করিয়া কাল কাটাইতে, পারিলেই তোমার জীবম সার্থক। আর বিলম্বঃ করিতেছ কেন ? আমার রাগ শুইতেছে । শৈ । দেখ, গৃহে থাকিতে মনে ভাবিতাম, যদি পিতৃমাতৃকুলে কাহারও অঙ্গুসন্ধান পাই, তবে তাহার গৃহে গিয়া থাকি । নচেৎ কাশী গিয়া ভিক্ষা করিয়া খাইব-নচেং জলে ডুবিয়া মরিব । এখন মুঙ্গের যাইতেছি। যাই, দেখি মুঙ্গের কেমন । দেখি, রাজধানীতে ভিক্ষ মিলে কি না । মরিতে হয়, ন হয় মরিব ; --মরণ ত হাতেই আছে । এখন আমার মরণ বৈ আর উপায় কি ? কিন্তু মরি আর বাচি, আমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, তার ঘরে ফিরিব না । তুমি অনৰ্থক আমার জন্য এত ক্লেশ করিলে –ফিরিয়া যাও । আমি যাইব না, মনে করিও, আমি মরি য়াছি । আমি মরিব, তাহ নিশ্চয় জানিও, তুমি যাও । তখন সুন্দরী আর কিছু বলিল না। রোদন সংবরণ করিয়! গাত্রোথনি করিল ; বলিল,“ভরসা করি, তুমি শীঘ্র মরিবে ! দেবতার কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, যেন মবিতে তোমার সাহস হয় । মুঙ্গেরে যাইবার পূৰ্ব্বেষ্ট যেন তোমার মৃত্যু হয় । ঝড়ে হৌক, তুফানে হোক, নৌকা ডুবিয়া হৌক, মুঙ্গেরে পেছিবার পূৰ্ব্বে গম তোমার মৃত্যু হয় ।” এই বলিয়। সুন্দরী নৌকামপ্য হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া আলুতার চুবড়ী জলে ছুড়িয়। ফেলিয়া দিয়া স্বামীর নিকট প্রত্যাবৰ্ত্তন করিল। পঞ্চম পরিচ্ছেদ tলদশেখরের প্রত্যাগমন চন্দ্রশেখর ভবিষ্যৎ গণিয়া দেখিলেন ; দেখিয়া রাজকৰ্ম্মচারীকে বলিলেন, “মহাশণ, আপণি নবাবকে জানাইবেন, আমি গণিতে পারিলাম না ।” রাজকন্মচারী জিজ্ঞাস করিলেন, “কেন মহাশয় ?” চন্দ্রশেখর বলিলেন, “সকল কথা গণনায় স্থির হয় না। যদি হইত, মানুষ সৰ্ব্বজ্ঞ হইত। বিশেষ জ্যোতিষে আমি আপারদর্শী |"