পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/১০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ইহ ঈদবীরের ন্যায় গোবিন্দলাল র্তাহার সম্মুখে দাড়াইয়৷ আছেন—ডাকিতেছেন, “জ্যেঠামহাশয় ।” কৃষ্ণকান্ত শশব্যস্তে উঠিয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বাবা গোবিন্দলাল ?” গোবিন্দলালকে বুড় বড় ভালবাসিত । গোবিন্দলালও কিছু অপ্রতিভ হইলেন—বলিলেন, আপনি নিদ্রা যান—আমি এমন কিছু কাজে আসি নাই ।” এই বলিয়। গোবিন্দলাল পিক্‌দানিটি উঠাইয়া, সোজা করিয়া রাখিয়া, পানবাট উঠাইয়া যথাস্থানে রাখিয়া নলটি কৃষ্ণকাস্তের হাতে দিলেন । কিন্তু কৃষ্ণকান্ত শক্ত বুড়া—সহজে ভুলে ন! - মনে মনে বলিতে লাগিলেন, “কিছু না, এ ছুচে। আবার সেই চাদমুখে মাগীর কথ। বলিতে আসিয়াছে ” প্রকাশ্বে বলিলেন, “না। আমার ঘুম হইয়াছে—আর ঘুমাইব , 'मां ” গোবিন্দলাল একটু গোলে পড়িলেন । রোহিণীর কথা কৃষ্ণকাস্তের কাছে বলিতে প্রাতে র্তাহার কোন লজ্জা করে নাই, এখন একটু লজ্জা করিতে লাগিল । কথা বলি বলি করিয়া বলিতে পারিলেন না । রোহিণীর সঙ্গে বারুণী-পুকুরের কথা হইয়াছিল বলিয়। কি এখন লজ্জ ? বুড় রঙ্গ দেখিতে লাগিল । গোবিন্দলাল কেন কথা পাড়িতেছে না দেখিয় আপনি জমাদারীর কথা পাড়িল—জমীদারীর কথার পর সাংসারিক কথা, সাংসারিক কথার পর মোকদ্দমার কথা, তথাপি রোহিণীর দিক্ দিয়াও গেল না ! গোবিন্দলাল রোহিণীর কথা কিছুতেই পাড়িতে পারিলেন না । কৃষ্ণকান্ত মনে শুনে ভারি হাসি হাসিতে লাগিলেন । বুড় বড় দুষ্ট । অগত্য গোবিন্দলাল ফিরিয়া ধাইতেছিলেন, - তখন কৃষ্ণকান্ত প্রিয়তম ভ্রাতুপুত্রকে ডাকিয় ফিরাইয়। জিজ্ঞাসা করিলেন, “সকলবেল ধে মাগকে তুমি জামিন হইয়া লইয়। গিয়াছিলে, সে মাগ৷ কিছু স্বীকার করিয়াছে ?” তখন গোবিন্দলাল পথ পাইয়া, যাহা যাহ। ষ্ট্রাহিণী বলিয়াছিল, সংক্ষেপে বলিলেন । বারুণী পুষ্ক ৱিীঘটিত কথাগুলি গোপন করিলেন। শুনিয়া কৃষ্ণ 蠶 “এখন তাহার প্রতি কিরূপ কর। § অভিপ্রায় ?” গোবিন্দলাল লজ্জিত হইয়া বলিলেন, “আপনার যে অভিপ্রায়; আমাদিগেরও সেই অভিপ্রায় ।” কৃষ্ণকান্ত মনে মনে হাসিয়া, মুখে কিছুমাত্র হাসির লক্ষণ না দেখাইয়া বলিলেন, “আমি উহার কথায় বিশ্বাস করি না। উহার মাথা মুড়াইয়া, ঘোল চলিয়া দেশের বাহির করিয়া দাও-কি বল ?” বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী গোবিন্দলাল চুপ করিয়া রহিলেন। তখন তুষ্ট বুড়া বলিল—“আর তোমরা যদি এমনই বিবেচনা কর যে, উহার দোষ নাই—তবে ছাড়িয়া দাও।” গোবিন্দলাল তখন নিশ্বাস ছাড়িয়া, বুড়ার হাভ হইতে নিস্কৃতি পাইলেন । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ রোহিণী গোবিন্দলালের অনুমতিক্রমে খুড়ার সঙ্গে বিদেশ যাওয়ার বন্দোবস্ত করিতে আসিল । খুড়াকে কিছু ন বলিয়। ঘরের মধ্যস্থলে বসিয়া পড়িয়া রোহিণী কাদিতে বসিল । “এ হরিদ্রাগ্রাম ছাড়িয় আমার যাওয়া হইবে না, ন। দেখিয়া মরিয়া যাইব । আমি কলিকাতায় গেলে গোবিন্দলালকে ত দেখিতে পাইব না ? আমি যাইব না । এই হরিদ্রাগ্রাম আমার স্বর্গ, এখানে গোবিন্দলালের মন্দির । এই হরিদ্রাগ্রামই আমার শ্মশান, এখানে আমি পুড়িয়া মরিব । শ্মশানে মরিতে পায় না, এমন কপালও অাছে ! আমি যদি এ হরিদ্রাগ্রাম ছাড়িয়। ন! যাই ত আমার কে কি করিতে পারে ? কৃষ্ণকান্ত রায় আমার মাথ। মুড়াইয়া, ঘোল ঢালিয়া, দেশছাড়া করিয়া দিবে ? আমি আবার আসিব । গোবিন্দলাল রাগ করিবে ? করে করুক —তবু আমি তাহাকে দেখিব । আমার চক্ষু ত কড়িয়া লইতে পরিবে না? আমি যাব না । কলিকাতায় যাব না।-কোথাও যাব না । ষাই ত যমের বাড়ী যাব । আর কোথাও ন৷ ” এই সিদ্ধাস্ত স্থির করিয়া, কালামুখী রোহিণী উঠিয় দ্বার খুলিয়। আবার পতঙ্গবন্ধহ্নিমুখং বিবিক্ষু -- সেই গোবিন্দলালের কাছে চলিল। মনে মনে বলিতে লাগিল --“হে জগদীশ্বর, হে দীননাথ, হে দুঃখিজনের একমাত্র সহায়, আমি নিতান্ত দুঃখে পড়িয়াছি --অমায় রক্ষা কর—আমার হৃদয়ের এই অসহ্য প্রেমবহ্নি নিবাইয়া দাও—আর আমায় পোড়াইও না । আমি যাহাকে দেখিতে খাইতেছি-- তাহাকে যতবার দেখিব, ততবার-আমার অসহ যন্ত্রণা--অনন্ত সুখ । আমি বিধবা—আমার ধৰ্ম্ম গেল --মুখ গেল-প্রাণ গেল -রহিল কি প্রভু ? রাখিব কি প্রভু ?—হে দেবতা –হে দুর্গ-হে কালী-হে জগন্নাথ—আমায় মুমতি দাও—আমার প্রাণ স্থির কর–আমি এই যন্ত্রণা আর সহিতে পারিব-না ।”