পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/১০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধাইত,—তবে আর তাহাকে ফুলবাগানের কাজ করিতে হইত না । সে খোন্ত, খুরপো, নিড়িন, কঁচি, কোদালি বরুণীর জলে ফেলিয়া দিয়া, এক . দৌড়ে ভদরক পানে ছুটিত, সন্দেহ নাই—বোধ হয়, -সুবর্ণরেখার নীলজলে ডুবিয়। মরিত । মালী অত ভাবিয়াছিল কি ন বলিতে পারি না, কিন্তু মালী ফু দিতে রাজি হইল না । অগত্য গোবিন্দলাল তাহাকে বলিলেন, “তবে তুই এইরূপ ইহার হাত দুইটি ধীরে ধীরে উঠাইতে থাক, আমি ফু দিই। তাহার পর ধীরে ধীরে হাত নামাইবি ।” মালী তাহ স্বীকার করিল । সে হাত দুইটি ধরিয়া ধীরে ধীরে উঠাইল । গোবিন্দলাল তখন সেই ফুল্লরক্তকুসুমকান্তি অধর যুগলে ফুল্লরক্তকুসুমকাস্তি অধর যুগল স্থাপিত করিয়া রোহিণীর মুখে ফুৎকার দিলেন । সেই সময়ে ভ্রমর একটা লাঠি লইয়। একট। বিড়াল মারিতে যাইতেছিল। বিড়াল মারিতে লাঠি বিড়ালকে না লাগিয়া, ভ্রমরেরই কপালে লগিল । মালী রোহিণীর বাহুদ্বয় নামাইল ; আবার উঠাইল । আবার গোবিন্দলাল ফুৎকার দিলেন, আবার সেইরূপ হইল ! আবার সেইরূপ পুনঃ পুনঃ করিতে লাগিলেন । দুই তিন ঘণ্ট। এইরূপ করিলেন । রোহিণীর নিশ্বাস বহিল । রোহিণী বাচিল । সপ্তদশ পরিচ্ছেদ রোহিণীর নিশ্বাস-প্রশ্বাস বহিতে লাগিলে গোবিন্দ লাল তাহাকে ঔষধ পান করাইলেন । ঔষধ বলকারক—ক্রমে রোহিণীর বলসঞ্চার হইতে লাগিল । রোহিণী চাহিয়া দেখিল –সজ্জিত রম গৃহমধ্যে মন্দ মশ শীতল পবন বাতায়নপথে পরিভ্রমণ করিতেছে,--- এক দিকে স্ফটিকাধারে স্নিগ্ধ প্রদীপ জলিতেছে—আর দিকে হৃদয়াধারের জীবনপ্রদীপ জলিতেছে । এ দিকে রোহিণী গোবিনলাল হস্তপ্রদত্ত মুতসঞ্জীবনী সুর। পান করিয়া মৃতসঞ্জীবিত হইতে লাগিল—আর এক দিকে তাঙ্কার মৃতসঞ্জীবনী কথা শ্রবণপথে পান করিয়৷ মৃত্যু সঞ্জীবিত হইতে লাগিল । প্রথমে নিশ্বাস, পরে চৈতন্ত, পরে দৃষ্টি, পরে স্মৃতি, শেষে বাক্য স্ফুরিত জুইতে লাগিল । রোহিণী বলিল, “আমি মরিয়াছিলাম, আমাকে কে বঁাচাইল ?” গোবিন্দলাল বলিলেন, “যেই বাচাক, তুমি ষে রক্ষা পাইয়াছ, এই যথেষ্ট !” . বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী प& রোহিণী বলিল, “আমাকে কেন বঁাচাইলেন ? আপনার সঙ্গে আমার এমন কি শক্রত যে, মরণেও আপনি প্রতিবাদী ?” গে। তুমি মরিবে কেন ? রে। । মরিবারও কি আমার অধিকার নাই ? গো । পাপে কাহারও অধিকার নাই। আত্মহত্য পাপ । - রে। । আমি পাপপুণ্য জানি না। —আমাকে কেহ শিখায় নাই । আমি পাপপুণ্য মানি না-কোন পাপে আমার এই দণ্ড ? পাপ ন করিয়াও যদি এই দুঃখ, তবে পাপ করিলেই বা ইহার বেশী কি হইবে ? আমি মরিব । এবার না হয় তোমার চক্ষে পড়িয়ছিলাম বলিয়। তুমি রক্ষা করিয়াছ, ফিরেবার যাহাতে তোমার চক্ষে ন! পড়ি, সে যত্ন করিব । গোবিন্দলাল বড় কাতর হইলেন, বলিলেন, “তুমি কেন মরিবে ?" “চিরকাল ধরিয়! দণ্ডে দণ্ডে, পলে পলে, রাত্রিদিন মরার অপেক্ষ একবারে মর ভাল ।” গে| কিসের এত যন্ত্রণ ? রে। রাত্রি দিন দারুণ তৃণ, হৃদয় পুড়িতেছে – সম্মুখেই শীতল জল, কিন্তু ইহজন্মে সে জল স্পর্শ করিতে পারিব না । আশাও নাই ! গোবিন্দলাল তখন বলিলন ঘে, “আর এ সব কথায় কাজ নাই, চল, তোমাকে গৃহে রাখিল। আসি ।" রোহিণী বলিল, “ন।, আমি একাই যাইব ।” গোবিন্দলাল বুঝিলেন, আপত্তিটা কি ! গোবিন্দ লাল আর কিছুই বলিলেন না। রোহিণী একাই গেল । তখন গোবিন্দলাল সেই বিজন কক্ষমধ্যে সহস। ভূপতিত হইয়া, ধূল্যবলুষ্ঠিত হইয়। রোদন করিতে লাগিলেন । মাটীতে মুখ লুকাইয়া, দরবিগলিত লোচনে ডাকিতে লাগিলেন, “হ নাথ ! নাথ ! তুমি আমায় এ বিপদে রক্ষ কর । তুমি বল না দিলে কাহার বলে আমি এ বিপদ হইতে উদ্ধার পাইব ? আমি মরিব —ভমর মরিবে । তুমি এই চিত্তে বিরাজ করিও— আমি তোমার বলে আত্ম-জয় করিব।” অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ গেবিন্দলাল গৃহে প্রত্যাগমন করিলে, ভ্রমর জিজ্ঞাসা করিল “আজি এত রাত্রি পর্য্যন্ত বাগানে ছিলে কেন ?” গে। কেন জিজ্ঞাসা করিতেছ? আর কখন কি থাকি না ?