পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/১১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

"কৃষ্ণকাস্তের উইল । হইয়া ইহজীবন নিৰ্ব্বাহ করিতে হইবে । অতএব সংসার ত্যাগ করাই ভাল, স্থির করিলেন । একে পতিহীনা, কিছু আত্মপরায়ণা, তিনি স্বামিবিয়োগকাল হইতেই কাশীযাত্রা কামনা করিতেন, কেবল স্ত্রীস্বভাবসুলভ পুত্রস্নেহবশতঃ এত দিন যাইতে পারেন নাই । এক্ষণে সে বাসনা আরও প্রবল হইল । তিনি গোবিন্দলালকে বলিলেন, “কৰ্ত্তারা একে একে স্বৰ্গারোহণ করিলেন, এখন আমার সময় নিকট হইয়। আসিল, তুমি পুত্রের কাজ কর, এই সময় আমাকে কাশী পাঠাইয়া দাও।” গোবিন্দলাল হঠাৎ এ প্রস্তাবে সম্মত হইলেন ; বলিলেন, “চল, আমি তোমাকে আপনি কাশী রাখিয়। আসিব ।” দুর্ভাগ্যবশতঃ এই সময়ে ভ্রমর একবার ইচ্ছা করিয়া পিত্রালয়ে গিয়াছিলেন । কেহই তাহাকে নিষেধ করে নাই । অতএব ভ্রমরের অজ্ঞাতে গোবিন্দলাল কাশীযাত্রার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন । নিজনামে কিছু সম্পত্তি ছিল, তাহা গোপনে বিক্রয় করিয়া অর্থ সঞ্চয় করিলেন । কাঞ্চনীরকাদি মূলাবানু বস্তু যাহ। নিজের সম্পত্তি ছিল—তাহা বিক্রয় করিলেন । এই রূপে প্রায় লক্ষ টাকা সংগ্ৰহ হইল । গোবিন্দলাল ইহার দ্বার। ভবিষ্যতে দিনপাত করিবেন স্থির করিলেন । তখন মাতৃসঙ্গে কাশীযাত্রার দিন স্থির করিয়া ভ্রমরকে আনিতে পাঠাইলেন । শাশুড়ী কাশীষাত্রা করিবেন শুনিয়া ভ্রমর তাড়াতাড়ি আসিল । আসিয়া শাশুড়ীর চরণে ধরিয়া অনেক বিনয় করিল ; শাশুড়ীর পদপ্রান্তে পড়িয়া কাদিতে লাগিল, “মা, আমি বালিকা—আমায় এক রাখিয়া যাইও নাআমি সংসারধৰ্ম্মের কি বুঝি ? মা,-সংসার সমুদ্র —আমাকে এ সমুদ্রে এক ভাসাইয়া যাইও না ।" শাশুড়ী বলিলেন, “তোমার বড় ননদ রহিল, সেই তোমাকে আমার মত যত্ন করিবে—আর তুমিও গৃহিণী হইয়াছ।” ভ্রমর কিছুই বুঝিল না—কেবল কাদিতে লাগিল । ভ্রমর দেখিল, বড় বিপদ সম্মুখে । শাশুড়ী ত্যাগ করিয়া চলিলেন—আবার স্বামীও তাহাকে রাখিতে চলিলেন–তিনিও রাখিতে গিয়া বুঝি আর না আইসেন। ভ্রমর গোবিন্দলালের পায়ে ধরিয়া কঁাদিতে লাগিল—বলিল, “কত-দিনে আসিবে, বলিয়া যাও ।" গোবিন্দলাল বলিলেন, “বলিতে পারি না । আসিতে বড় ইচ্ছা নাই ।” ভ্রমর পা ছাড়িয়া দিয়া উঠিয়া দাড়াইয়া মনে ভাবিল, “ভয় কি ? বিষ খাইব ।” రిసీ তার পর স্থিরীকৃত যাত্রার দিবস আসিয়া উপস্থিত হইল । হরিদ্রাগ্রাম হইতে কিছু দূরে শিবিকারোহণে গিয়া ট্রেণ পাইতে হইবে । তৃভষাত্রিক লগ্ন উপস্থিত ; —সকল প্রস্তুত । ভারে ভারে সিন্দুক, তোরঙ্গ, বাক্স, ব্যাগ, গাটরী বাহকের বহিতে আরম্ভ করিল । দাসদাসী সুবিমল ধৌত বস্ত্র পরিয়া, কেশ রঞ্জিত করিয়া, দরজার সম্মুখে দাড়াইয়া পান । চিবাইতে লাগিল, তাহার সঙ্গে যাইবে । দ্বারবানেরা - ছিটের জামার বন্ধক অঁাটিয়া, লাঠি হাতে করিয়া, বাহকদিগের সঙ্গে বকবিকি আরম্ভ করিল। পাড়ার মেয়ে ছেলে দেখিবার জন্য ঝুঁকিল। গোবিন্দলালের মাতা গৃহদেবতাকে প্রণাম করিয়া পৌরজন-সকলকে যথাযোগ্য সম্ভাষণ করিয়া কাদিতে কাদিতে শিবিকারোহণ করিলেন । পৌরজন সকলেই কাদিতে লাগিল ; তিনি শিবিকারোহণ করিয়া অগ্রসর হইলেন । এ দিকে গোবিন্দলাল অন্যান্ত পৌরস্ত্রীগণকে যথোচিত সম্বোধন করিয়া শয়নগৃহে রোরুদ্যমান৷ ভ্রমরের কাছে বিদায় হইতে গেলেন। ভ্রমরকে রোদনবিবশ দেখিয়া তিনি যাহা বলিতে আসিয়াছিলেন, তাহা বলিতে না পারিয়া কেবল বলিলেন, "ভ্রমর । আমি মাকে রাখিতে চলিলাম।” ভ্রমর চক্ষের জল মুছিয়া বলিল, “ম| সেখানে বাস করিবেন । তুমি আসিবে না কি ?” এ কথা যখন ভ্রমর জিজ্ঞাসা করিল, তখন তাহার চক্ষের জল শুকাইয়া গিয়াছিল তাহার স্বরের স্থৈৰ্য্য, গাম্ভীৰ্য্য, তাহার অধরে স্থিরপ্রতিজ্ঞ দেখিয়া গোবিনলাল কিছু বিস্মিত হইলেন । হঠাৎ উত্তর করিতে পারিলেন না। ভ্রমর স্বামীকে নীরব দেখিয়া পুনরপি বলিল, “দেখ, তুমি আমাকে শিখাইয়াছ, সত্যই একমাত্র ধৰ্ম্ম, সত্যই একমাত্র সুখ, আজি আমাকে তুমি সত্য বলিও—আমি তোমার আশ্রিত বালিকা, আমায় আজি প্রবঞ্চন করিও না—কবে আসিবে ?” গোবিন্দলাল বলিলেন, “তবে সত্যই শোন । ফিরিয়া আসিবার ইচ্ছা নাই ।” ভ্রমর । কেন ইচ্ছা নাই—তাহ বলিয়া যাইবে ন। কি ? গো । এখানে থাকিলে তোমার অন্নদাস হইয়া থাকিতে হুইবে । ভ্রমর । তাঁহাতেই বা ক্ষতি কি ? আমি ত : তোমার দাসান্তদাসী । * ... ? গো । আমার দাসাচুদাসী ভ্রমর, অামার : প্রবাস হইতে আসার প্রতীক্ষায় জানালায় বসিয়া