পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/১২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

*:: থাকিবে, তেমন সময়ে সে পিত্রালয়ে গিয়া বসিয়া থাকে না । ভ্রমর । তাহার জন্য কত পায়ে ধরিয়াছি—এক পরাধ কি মার্জনা হয় না ? গো । এখন সেরূপ শত অপরাধ হইবে । তুমি এখন বিষয়ের অধিকারিণী । ভ্রমর । তা নয়, আমি এবার বাপের বাড়ী গিয়া বাপের সাহাষ্যে যাহা করিয়াছি, তাহা দেখ । এই বলিয়া ভ্রমর একখানা কাগজ দেখাইলেন । গোবিন্দলালের হাতে তাহা দিয়া বলিলেন, “পড় ।” গোবিন্দলাল পড়িয়া দেখিলেন—দানপত্র, ভ্রমর উচিত মূল্যের ষ্ট্যাম্পে আপনার সমুদয় সম্পত্তি স্বামীকে দান করিতেছেন । তাহ রেজেষ্টারী হইয়াছে । গোবিন্দলাল পড়িয়া বলিলেন, “তোমার মোগা কাজ তুমি করিয়াছ, কিন্তু তোমায় আমায় কি সম্বন্ধ ? আমি তোমায় অলঙ্কার দিব, তুমি পরিবে, তুমি বিষয় দান করিবে, আমি ভোগ করিব –এ সম্বন্ধ নহে ।” এই বলিয়া গোবিন্দলাল বহুমূল্য দানপত্ৰখানি খণ্ড খণ্ড করিয়া ছিড়িয়া ফেলিলেন । ভ্রমর বলিলেন, “পিতা বলিয়া দিয়াছেন, ইষ্ট| ছিড়িয়া ফেল বৃথা । সরকারীতে ইহার নকল আছে ।” গে। । থাকে থাক । আমি চলিলাম । ভ্রমর । কবে আসিবে ? গে। আসিব ন! । ভ্র । কেন ? আমি তোমার স্ত্রী, শিমৃ্যা, আশ্রিতা, প্রতিপালিতা—তোমার দাসান্তদাসী—তোমার কথার ভিখারী—আসিবে ন! কেন ? গে। ইচ্ছা নাই । ভ্র । ধৰ্ম্ম নাই কি ? গে| বুঝি আমার তাও নাই । বড় কষ্টে ভ্রমর চক্ষের জল রোধ করিল। হুকুমে চক্ষের জল ফিরিল—ত্রমর ষোড় হাত করিয়া আবি কম্পিত কণ্ঠে বলিতে লাগিল, “তবে যাও—পার, আসিও না । বিনাপরাধে আমাকে ত্যাগ করিতে চাও, কর্য—কিন্তু মনে রাখিও, উপরে দেবত আছেন । মনে রাখিও, এক দিন আমার জন্য তোমাকে কাদিতে হইবে। মনে রাখিও—এক দিন তুমি খুজিবে, এ পুথিবীতে অকৃত্রিম আন্তরিক স্নেহ কোথায় ? দেবত সাক্ষী । যদি আমি সতী হই, কায়মনোবাক্যে তোমার পায় আমায় ভক্তি থাকে, তবে তোমায় আমায় আবার সাক্ষাৎ হইবে । আমি সেই আশায় প্রাণ রাখিব ! এখন যাও, বলিতে ইচ্ছা হয়, বল যে, আর

  • বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী

আসিব না । কিন্তু আমি বলিতেছি—আবার আসিবে—আবার ভ্রমর বলিয়া ডাকিবে—আমার জন্ত কঁাদিবে। যদি এ কথা নিষ্ফল হয়, তবে জানিও —দেবতা মিথ্যা, ধৰ্ম্ম মিথ্যা, ভ্রমর অসতী ! তুমি যাও, আমার দুঃখ নাই। তুমি আমারই—রোহিণীর নও । এই বলিয়। ভ্রমর ভক্তিভাবে স্বামীর চরণে প্রণাম করিয়া গজেন্দ্রগমনে কক্ষাস্তরে গমন করিয়া দ্বার রুদ্ধ করিল। একত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ এই আখ্যায়িক আরম্ভের কিছু পূৰ্ব্বে ভ্রমরের একটি পুত্ৰ হইরা স্থতিকাগারেই নষ্ট হয়, ভ্রমর আজি কক্ষান্তরে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়! সেই সাত দিনের ছেলের জন্য কাদিতে বসিল । মেঝের উপর পড়িয়া ধূলায় লুটাইয়। অশমিত নিশ্বাসে পুত্রের জন্য কাদিতে লাগিল—“আমার ননীর পুতলী, আমার কাঙ্গালের সোনা, আজ তুমি কোথায় ? অাঙ্গ তুই থাকিলে আমায় কার সাধা ত্যাগ করে ? আমার মায়। কাটাইলেন, তোর মায়া কে কটাইত ? আমি কুরূপ। কুৎসিত, তোকে কে কুৎসিত বলিত ? তোর চেয়ে কে স্বন্দর ? একবার দেখা দে বাপ—এই বিপদের সময় একবার কি দেখা দিতে পারিস না ? মরিলে কি আর দেখ দেয় না ?” ভ্রমর তখন যুক্তকরে মনে মনে উৰ্দ্ধমুখে অথচ অস্ফুটবাকো দেবতাদিগকে জিজ্ঞাস করিতে লাগিল-- “কেহ আমাকে বলিয়া দাও, আমার কি দোসে এই সতের বৎসরমাত্র বয়সে এমন অসম্ভব দশ ঘটিল । আমার পুল্ল মরিয়াছে—আমায় স্বামী ত্যাগ করিল ; আমার সতের বৎসরমাত্র বয়স—আমি এই বয়সে স্বামীর ভালবাস বিনা আর কিছু ভালবাসি নাই – আমার ইহলোকে আর কিছু কামনা নাই—আর কিছুই কামনা করিতে শিখি নাই –আমি আজ এই সতের বৎসর বয়সে তাহাতে নিরাশ হইলাম কেন ?" ভ্রমর কঁাদিয়া কাটিয়া সিদ্ধান্ত করিল—দেবতারা নিতান্ত নিষ্ঠুর । যখন দেবতা নিষ্ঠুর, তখন মনুষ্ঠা আর কি করিবে, কেবল কাদিবে। ভ্রমর কেবল কাদিতে লাগিল । এ দিকে গোবিন্দলাল ভ্রমরের নিকট হইতে বিদায় হইয়। ধীরে ধীরে বহিৰ্ব্বাটতে আসিলেন । আমরা সত্য কথা বলিব—গোবিনলাল চক্ষের জল মুছিতে মুছিতে