嶽: * ধাইতেছে না। নিশাকর সেই গীত শুনিতেছেন এবং, গোবিন্দলালের বাসগৃহের দ্বিতল কক্ষের “বাঙায়ননিঃস্থত উজ্জল দীপালোক দর্শন করিতেছেন, এবং মনে মনোভাবিতেছেন, “আমি কি নৃশংস ! এক জন স্ত্রীলোকের সৰ্ব্বনাশ করিবার জন্য কত কৌশল করিতেছি । অথবা নৃশংসতাই ব কি ? ছষ্টের দমন অবশুই কৰ্ত্তব্য, যখন বন্ধুর কন্যার জীবনরক্ষার্থ এ কার্য্য বন্ধুর নিকটে স্বীকার করিয়াছি, তখন অবশু করিব । কিন্তু আমার মন ইহাতে প্রসন্ন নয় । রোহিণী পাপীয়সী, পাপের দণ্ড দিব, পাপস্রোতের .রোধ করিব, ইহাতে অপ্রসাদই বা কেন ? বলিতে পারি না, বোধ হয়, সেজা পথে গলে অত ভাবিতাম না । বাক পথে গিয়াছি বলিয়াই এত সঙ্কোচ হইতেছে । আর পাপ-পুণ্যের দণ্ড পুরস্কার দিবার আমি কে ? আমার পাপ-পুণ্যের যিনি দণ্ড পুরস্কার করিবেন, রোহিণীরও তিনি বিচারকর্তা ! বলিতে পারি না, হয় ত তিনিই আমাকে এই কার্য্যে নিয়োজিত করিয়াছেন । কি জানি – “ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদিস্থিতেন, যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি।" এই চিন্তা করিতে করিতে রাত্রি প্রহরাতীত হুইল। তখন নিশাকর দেখিলেন, নিঃশব্ৰুপাদবিক্ষেপে রোহিণী আসিয়া কাছে দাড়াইল । নিশ্চয়কে .সুনিশ্চিত করিবার জন্য নিশাকর জিজ্ঞাস করিলেন, “কে গা ?” রোহিণীও নিশ্চয়কে সুনিশ্চিত করিবার জন্য বলিল, “তুমি কে ?” নিশাকর বলিল, “আমি রাসবিহারী।” রোহিণী বলিল, “আমি রোহিণী |" নিশা । এত রাত্রি হলে কেন ? রোহিণী। একটু না দেখে শুনে ত আসতে পারি নে। কি জানি, কে কোথায় দিয়ে দেখতে পাবে । ত তোমার বড় কষ্ট হয়েছে । নিশা । কষ্ট হোক, মনে মনে ভয় ইষ্টতেছিল যে, তুমি বুঝি ভুলিয়া গেলে । - রোহিণী । আমি যদি ভুলিবার লোক হইতাম, তা, হলে আমার দশা এমন হইবে কেন ? এক "জৰকে ভুলিতে ন পারিয়া এ দেশে আসিয়াছি, আর উজি তোমাকে না ভুলিতে পারিয়া এখানে আসিস্বাছি । এই কথা বলিতেছিল, এমন সময়ে কে আসিয়া পিছন হইতে রোহিণীর গলা টিপিয়া ধরিল । রোহিণী চমকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কে রে?” fi i יקא־s : গম্ভীরভাবে কে উত্তর করিল, “তোমার যম ।" রোহিণী চিনিল যে গোবিন্দলাল । তখন আসন্ন বিপদ বুঝিয়া, চারিদিক্ অন্ধকার দেখিয়া রোহিণী ভীতবিকম্পিত স্বরে বলিল, “ছাড়, ছাড় । আমি মন্দ অভিপ্রায়ে আসি নাই । আমি যে জন্য আসিয়াছি, এই বাবুকে না হয় জিজ্ঞাস কর ।” এই বলিয়া রোহিণী যেখানে নিশাকর বসিয়াছিল, সেই স্থানে অঙ্গুলিনিন্দেশ করিয়া দেখাইল । দেখিল, কেহ সেখানে নাই । নিশাকর গোবিন্দলালকে দেখিয়৷ পলকমধ্যে কোথায় সরিয়া গিয়াছে। রোহিণী বিস্মিত হইয়া বলিল, “কৈ, কেহ কোথাও নাই যে " গোবিন্দলাল বলিলেন, “এখানে কেহ নাই । আমার সঙ্গে ঘরে এস ।" রোহিণী বিষগ্নচিত্তে ধীরে ধীরে গোবিন্দলালের সঙ্গে ঘরে ফিরিয়া গেল । নবম পরিচ্ছেদ গৃহে ফিরিয়া আসিয়। শাবিন্দলাল ভূতাবৰ্গকে নিয়েধ করিলেন, “কেল্লাহ উপরে আসি ও না ।” ওস্তাদজী বাসায় গিয়ছিল । গোবিন্দলাল রোহিণীকে লক্টর। নিভৃতে শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া দ্বার রুদ্ধ করলেন ; রাহিণী সম্মুখে নদীস্রোতো বিকম্পিত। বেতসার ন্যায় দাড়াইয়। কাপিতে লাগিল । গোবিন্দলাল মুক্তস্বরে বলিল, “রোহিণী |" রোহিণী বলিল, “কেন ?" গো ! তোমার সন্সে গোটাকতক কথা আছে । রে। । কি ? গো । তুমি আমার কে ? পুরা । কেহ নহি, যত দিন পায়ে রাখেন, তত দিন দাসী, নইলে কেষ্ট নষ্ট । গো । পায়ে ছেড়ে তোমায় মাথায় রাখিয়াছিলাম। রাজার স্যায় ঐশ্বৰ্ঘ্য, রাজার অধিক সম্পদৃ, অকলঙ্ক চরিত্র, অত্যাজ ধৰ্ম্ম, সব তোমার জন্ত ত্যাগ করিয়াছি, তুমি কি, রোহিণি, যে তোমার জন্য এ সকল পরিত্যাগ করিয়া বনবাসী হইলাম—তুমি কি রোহিণি, যে তোমার জন্য ভ্রমর,—জগতে অতুল, চিস্তায় সুখ, সুখে অতৃপ্তি, দুঃখে অমৃত, যে ভ্রমর, তাহা পরিত্যাগ করিলাম ? এই বলিয়া গোবিন্দলাল আর দুঃখ-ক্রোধের বেগ সংবরণ করিতে না পারিয়া রোহিণীকে পদাঘাত করিলেন ।
পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/১৩২
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।