পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/১৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কৃষ্ণকাস্তের উইল লইয়া গিয়াছে। প্রসাদপুরের বাজারে দুই এক দিন বাস করিয়া গোবিন্দলাল বাড়ীর অবশিষ্ট ইট-কাঠ জলের দামে এক ব্যক্তিকে বিক্রয় করিয়া যাহা কিছু পাইলেন, তাহা লইয়া কলিকাতায় গেলেন । কলিকাতায় অতি গোপনে সামান্ত অবস্থায় গোবিনালাল দিনযাপন করিতে লাগিলেন। প্রসাদপুর হইতে অতি অল্প টাকাই আনিয়াছিলেন, তাহা এক বৎসরে ফুরাইয়া গেল। আর দিনপাতের সম্ভাবন নাই । তখন ছয় বৎসরের পর গোবিন্দলাল মনে ভাবিলেন, ভ্রমরকে একখানি পত্র লিখিব । গোবিনালাল কালি, কলম, কাগজ লষ্টয়া ভ্রমরকে পত্র লিখিব বলিয়া বসিলেন । আমরা সত্য বলিব, গোবিন্দলাল পত্র লিখিতে আরম্ভ করিতে গিয়া কঁদিলেন । কঁাদিতে কাদিতে মনে পড়িল, ভ্রমর যে আজিও বঁচিয়া আছে, তাহারই বা ঠিকানা কি ? কাহাকে পত্র লিখিব ? তার পর ভাবিলেন, একবার লিখিয়াই দেখি। ন হয় আমার পত্র ফিরিয়া আসিবে, তাহ হইলেই জানিব যে, ভ্রমর নাই । কি লিখিব, এ কথা গোবিনলাল কতক্ষণ ভাবিলেন, তাহা বলা যায় না । তার পর শেষ ভাবিলেন, যাহাকে বিনাদোষে জন্মের মত ত্যাগ করিয়াছি, তাহাকে যা হয় "ই লিখিলেই ব৷ অধিক কি ক্ষতি হইবে ? গোবিনালাল লিখিলেন, - “প্ৰমর ! ছয় বৎসরের পর এ পমির আবার তোমায় পত্র লিখিতেছে । প্রবৃত্তি হয় পড়িও না প্রবৃত্তি হয়, না পড়িয়াই ছিড়িয়। ফেলিও । “আমার অদৃষ্ট যাহা যাহা ঘটিয়াছে, বোধ হয়, সকলই তুমি শুনিয়াছ ! যদি বলি, সে আমার কৰ্ম্ম ফল, তুমি মনে করিতে পার, আমি তোমার মনরাখা কথা বলিতেছি । কেন না, আজি আমি তোমার কাছে ভিখারী । “আমি এখন নিঃস্ব । তিন বৎসর ভিক্ষা করিয়৷ দিনপাত করিয়াছি। তীর্থস্তানে ছিলাম, তীর্থস্তানে ভিক্ষ মিলিত । এখানে ভিক্ষ মিলে না—সুতরাং আমি অন্নাভাবে মারা যাইতেছি । “আমার যাইবার এক স্থান ছিল—কাশীতে মাতৃ ক্রোড়ে । মার কাশীপ্রাপ্তি হইয়াছে—বোধ হয় তাহা তুমি জান । সুতরাং আমার আর স্থান নাই—অন্ন নাই ! “তাই আমি মনে করিয়াছি, আবার হরিদ্রাগ্রামে এ কালামুখ দেখাইব—নহিলে খাইতে পাই না । যে তোমাকে বিনাপরাধে পরিত্যাগ করিয়া পরদারনিরত ૯૧ হইল, স্ত্রীহত্যা পর্য্যন্ত করিল, তাহার আবার লজ্জা কি ? যে অন্নহীন, তাহার আবার লজ্জা কি ? আমি এ কালামুখ দেখাইতে পারি, কিন্তু তুমি বিষয়াধিকারিণী—বাড়ী তোমার—আমি তোমার বৈরিতা করিয়াছি,—আমায় তুমি স্থান দিবে কি ? “পেটের দায়ে তোমার আশ্রয় চাহিতেছি—দিবে না কি ?” পত্র লিখিয়া সাত-পাচ আবার ভাবিয়া গোবিন্দলাল পত্র ডাকে দিলেন । যথাকালে পত্র ভ্রমরের হস্তে পৌছিল । পত্র পাইয়াই ভ্রমর হস্তাক্ষর চিনিল। পত্র খুলিয়া কাপিতে কঁাপিতে ভ্রমর শয়নগৃহে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিল। তখন ভ্রমর বিরলে বসিয়া নয়নের সহস্ৰ পারা মুছিতে মুছিতে সেই পত্র পড়িল ৷ একবার, চেষ্টবার শতবার, সহস্রবার পড়িল । সেদিন ভ্রমর আর দ্বার খুলিল না । যাহারা আহারের জন্য তাহাকে ডাকিতে আসিল, তাহাদিগকে বলিল, “আমার জর হইয়াছে—আহার করিব না।” ভ্রমরের সৰ্ব্বদ জর হয় : সকলে বিশ্বাস: করিল । - পরদিন নিদ্রাশষ্ঠ শয্যা হইতে যখন ভ্রমর গাত্রোথান করিলেন, তখন তাহার যথার্থই জ্বর হইয়াছে। কিন্তু তখন চিত্ত স্থির-বিকারশূন্ত । পত্রের উত্তর ষাহ লিখিবেন, তাহ পূৰ্ব্বেই স্থির হইয়াছিল । ভ্রমর তাহা সহস্ৰ সহস্রবার ভাবিয়া স্থির করিয়াছিলেন ; এখন আর ভাবিতে হইল.না ! পাঠ পর্যন্ত স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন । “সেবিক।" পাঠ লিখিলেন না । কিন্তু স্বামী সকল অবস্থাতেই প্রণমা, অতএব লিখিলেন,– ' “প্রণাম। শত সহস্র নিবেদনঞ্চ বিশেষ" তার পর লিখিলেন, “আপনার পত্র পাইয়াছি। বিষয় আপনার । আমার হষ্টলেও আমি উহ। দান করিয়াছি । —খাইবার সময় আপনি সে দানপত্র ছিড়িয়া ফেলিয়াছিলেন, স্মরণ থাকিতে পারে । কিন্তু রেজিষ্ট্ৰী অফিসে তাহার নকল আছে । আমি যে দান করিয়াছি, তাহ সিদ্ধ । তাহ এখনও বলবৎ ৷ “অতএব আপনি নিৰ্ব্বিঘ্নে হরিদ্রাগ্রামে আসিয়া আপনার নিজ সম্পত্তি দখল করিতে পারেন । বাড়ী আপনার । “আর এই পাঁচ বৎসরে আমি অনেক টাকা জমাইয়াছি । তাহাও আপনার । আসিয়া গ্রহণ করিবেন । -