পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/১৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কৃষ্ণকাস্তের উইল যামিনী আর কতক্ষণ কান্না রাখিবে ? ক্রমে রাত্রি হইতে লাগিল । লমর জিজ্ঞাসা করিলেন, “দিদি, রাত্রি কি জ্যোৎস্ন ?” যামিনী জানেল খুলিয়৷ দিয়া বলিল “দিব্য জ্যোৎস্না উঠিয়াছে।” ভ্র । তবে জানেলাগুলি সব খুলিয়া দাও—আমি জ্যোৎস্ন দেখিয়। মরি। দেখ দেখি, ঐ জানেলার নীচে ষে ফুলবাগান, উহাতে ফুল ফুটিয়াছে কি না ? সেই জানেলায় দাড়াইয়া প্রভাতকালে ভ্রমর গোবিন্দলালের সঙ্গে কথোপকথন করিতেন । আজ সাত বৎসর ভ্রমর সে জানেলার দিকে যান নাই--সে জানেল খোলেন নাই । যামিনী কষ্টে সেই জানেল। পুলিয়। বলিল, “কষ্ট, এখানে ত ফুলবাগান নাই—এখানে কেবল খভুবন--- আর দুষ্ট একটা মর। মরা গাছ আছে—তাহাতে ফুল পাত কিছুষ্ট নাই ।” ভ্রমর বলিল, “সাত বৎসর হইল, ওখালে ফুলবাগান ছিল । বোমেরামতে গিয়াছে । আমি সাত বৎসর দেখি নাই ।” অনেকক্ষণ ভ্রমর নীরব গুচয়। রুচিলেন । তার পর ভ্রমর বললেন, “যেখান ইষ্টতে পার দিদি, আজি আমায় ফুল তানাইয়। দিতে হইবে । দেখিতেছ না, আজি আবার আমার ফুলশয় । " যামিনীর আজ্ঞ পাইয়। দাস-দাসী রাশীরুত ফুল আনিয়া দিল । ভ্রমর বলিল, “ফুল আমার বিছানায় ছড়াইয়। দাও । আজ আমার ফুলশম " যামিনী তাহাই করিল। তখন লমরের চক্ষু দিয়। জলধারা পড়িতে লাগিল ! বার্মিণী বলিল, “কাদিতেছ কেন দিদি ?” ভ্রমর বলিল, “দিদি, একটি বড় তুঃখ রহিল । সে দিন তিনি আমায় ত্যাগ করির কাশী সান, সেই দিন যোড়হাতে কাদিতে কঁাদিতে দেবতার কাছে ভিক্ষা চাহিয়াছিলাম, এক দিন যেন তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় ; স্পৰ্দ্ধা করিয়া বলিয়াছিলাম, ‘আমি যদি সতী হই, তবে আবার ঠার সঙ্গে সাক্ষাৎ হুইবে ।’ কই আর ত দেখা হইল না । আজিকার দিন—মরিবার দিনে, দিদি, যদি একবার দেখিতে পাইতাম । এক দিনে, দিদি, সাত বৎসরের দুঃখ ভুলিতাম।" ষামিনী বলিল, “দেখিবে ?" ত্রমর যেন বিদ্যুৎ চমকিয়া উঠিল। বলিল—“কার কথা বলিতেছ?” ষামিনী স্থির ভাবে বলিল, “গোবিমলালের কথা, তিনি এখানে আছেন—বাবা তোমার পীড়ার সংবাদ তাহাকে দিয়াছিলেন । শুনিয়া ২য়—১৮ &సి" তোমাকে একবার দেখিবার জন্য তিনি আসিয়াছেন, আজ পৌঁছিয়াছেন । তোমার অবস্ত দেখিয়া ভয়ে এতক্ষণ তোমাকে বলিতে পারি নাই—তিনিও সাহস করিয়া আসিতে পারেন নাই ।” ভ্রমর কাদিয়া বলিল, “একবার দেখা দিদি ! ইহজন্মে আর একবার দেখি ! এই সময়ে আর একবার দেখা ” যামিনী উঠিয় গেল । অল্পক্ষণ পরে নিঃশব্দপাদবিক্ষেপে গোবিন্দলাল—সাত বৎসরের পর নিজ শয্যাগৃহে প্রবেশ করিলেন । দুই জনেষ্ট কঁাদিতেছিল । এক জনও কথা কহিতে পারিল না । ভ্রমর স্বামীকে কাছে আসিয়। বিছানায় বসিতে ইঙ্গিত করিল –গোবিন্দলাল কঁাদিতে কঁাদিতে বিছানায় বসিল । ভ্রমর ভাহাকে আরও কাছে আসিতে বলিল,—গোবিন্দলাল আরও কাছে গেল। তখন ভ্রমর আপনার করতলের নিকট স্বামীর চরণ পাইয়া, সেই চরণযুগল স্পর্শ করিয়া পদরেণু লষ্টয়া মাথায় দিল । বলিল, “আজ আমার সকল অপরাধ মার্জনা করিয়া আশীৰ্ব্বাদ করিও, জন্মাস্তরে যেন সুখী হই ।” গোবিন্দলাল কোন কথা কহিতে পারিলেন ন। ভ্রমরের হাত আপন হাতে তুলিয়া লইলেন । সেইরূপ হাতে হাত রহিল । অনেকক্ষণ রহিল, ভ্রমর নিঃশব্দে প্রাণত্যাগ করিল। পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ লমর মরিয়া গেল । যথারীতি তাহার সৎকার হইল । সৎকার করিয়া আসিয়া গোবিনলাল গৃহে বসিলেন । গুহে প্রত্যাবৰ্ত্তন করিয়া অবধি তিনি কাহারও সহিত কথা কহেন নাই । আবার রজনী পোহাইল । ভ্রমরের মৃত্যুর পরদিন, যেমন স্বৰ্ষ প্রতাই উঠিয়া থাকে, তেমনি উঠিল । গাছের পাতা ছায়ালোকে উজ্জ্বল হইল । সরোবরে ক্লষ্ণবারি ক্ষুদ্র বীচিবিক্ষেপ করিয়া জ্বলিতে লাগিল ; আকাশের কালমেঘ শাদ হইল-ভ্রমর যেন মরে নাই । গোবিন্দলাল বাহির হইলেন । গোবিন্দলাল দুই জন স্ত্রীলোককে ভালবাসিয়াছিলেন--ত্রমরকে আর রোহিণীকে । রোহিণী মরিল – ভ্রমর মরিল । রোহিণীর রূপে আকৃষ্ট হইয়াছিলেন— যৌবনের অতৃপ্ত রূপতৃষা শাস্ত করিতে পারেন নাই । ভ্রমরকে ত্যাগ করিয়া রোহিণীকে গ্ৰহণ করিলেন ।