পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/১৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিবর্তে কঞ্চির বেড়া । ভ্রমর গোবিন্দলালের জন্য সকল সম্পত্তি যত্নে রক্ষা করিয়াছিলেন, কিন্তু এ উদ্যানের প্রতি কিছুমাত্র যত্ন করেন নাই। এক দিন যামিনী সে বাগানের কথা বলিয়াছিলেন । ভ্রমর বলিয়াছিল, “আমি যমের বাড়ী ঢলিলাম-—আমার সে নন্দনকানন ধ্বংস হউক । দিদি, পৃথিবীতে যা আমার স্বৰ্গ ছিল—তা আর কাহাকে দিয়া যাইব ?” গোবিন্দলাল দেখিলেন, ফটক নাই –রেলিং পড়িয়া গিয়াছে। প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, ফুলগাছ নাই —কেবল উলুবন, আর কচুগাছ, ঘেটুকুলের গাছ, কালকাসান্দা গাছে বাগাম পরিপূর্ণ। লতামণ্ডপ সকল ভাঙ্গিয়া পড়িয়া গিয়াছে –প্রস্তরমূৰ্ত্তিসকল দুই তিন খণ্ডে বিভক্ত হইয়া ভূমে গড়াগড়ি ঘাইতেছে, ভাঙ্গার উপর লত। সকল ব্যাপিয়াছে, কোনটা ব| ভগ্নাবস্থায় দণ্ডায়মান আছে । প্রমোদভবনের ছাদ ভাঙ্গিয়। গিয়াছে –ঝিলিমিলি সার্শি কে ভাঙ্গিয়া লইয়। গিয়াছে । মৰ্ম্মরপ্রস্তর সকল কে হুম্মাতল হইতে খুলিয়। তুলিয়। লইয়া গিয়াছে । সে বাগানে আর ফুল ফুটে না, ফল ফলে না -বুঝি সুবাতাসও তার বয় না। একটা ভগ্ন প্রস্তরমূৰ্ত্তির পদতলে গোবিন্দলাল বসিলেন । ক্রমে মধ্যান্সকাল উপস্থিত হইল, গোবিন্দলাল সেইখানে বসিয়৷ রঙ্গিলেন । প্রচণ্ড স্তর্যের তেজে তাহার মস্তক উত্তপ্ত হইয়। উঠিল ; কিন্তু গোবিন্দলাল কিছুই অনুভব করিলেন না । তাহার প্রাণ মায় ! রাত্রি অবধি কেবল ভ্রমর ও রোহিণী ভাবিতেছিলেন । একবার ভ্রমর, তার পর রোহিণী, আবার ভ্রমর, আবার রোহিণী । ভাবিতে ভাবিতে চক্ষে ভ্রমরকে দেখিতে লাগিলেন, সম্মুখে রোহিণীকে দেখিতে লাগিলেন--জগৎ ভ্রমর রোহিণীময় হইয়। উঠিল । সেই উদ্যানে বসিয়। প্রত্যেক বুক্ষকে ভ্রমর বলিয়৷ শ্ৰম হইতে লাগিল—প্রত্যেক বৃক্ষচ্ছায়ায় রোহিণী বসিয়া আছে দেখিতে লাগিলেন । এই ভ্রমর দাড়াইয়াছিল—আর নাই –এই রোহিণী আসিল, আবার কোথায় গেল ? প্রতি শব্দে ভ্রমর বা রোহিণীর কণ্ঠ শুনিতে লাগিলেন : ঘাটে স্নানকারীর কথা কহিতেছে, তাহাতে কখনও বোধ হইল, ভ্রমর কথা কহিতেছে, কখনও বোধ হইতে লাগিল, রোহিণী কথা কহিতেছে—কখনও বোধ হইল, তাহার দুই জনে কথোপকথন করিতেছে । শুষ্ক পত্র নড়িতেছে-বোধ হইল, ভ্রমর আসিতেছে। বনমধ্যে বন্ত কীটপতঙ্গ নড়িতেছে—বোধ হইল, রোহিণী পলাইতেছে । বাতাসে শাখা জুলিতেছে,— تنها বোধ হইল, ভ্রমর নিশ্বাসত্যাগ করিতেছে—দয়েল, ডাকিলে বোধ হইল, রোহিণী গান করিতেছে । জগৎ, ভ্রমর রোহিণীময় হইল । . ' বেলা দুষ্ট প্রহর-আড়াই প্রহর হইল—গোবিন্দ-. লাল সেইখানে—সেই ভগ্নপুত্তলপদতলে—সেই ভ্রমর" রোহিণীময় জগতে । বেল। তিন প্রহর, সাৰ্দ্ধ তিন? প্রহর হইল—অক্ষাত অনাহারী গোবিন্দলাল সেইখানে, সেই ভ্রমর রোহিণীময় অনলকুণ্ডে । সন্ধ্যা হইল, তথাপি গোবিন্দলালের উত্থান নাই—চৈতন্য নাই । তাহার পৌরজন তাহাকে সমস্ত দিন না দেখিয়া মনে করিয়াছিল, তিনি কলিকাতায় চলিয়। গিয়াছেন, সুতরাং তাহার অধিক সন্ধান করে নাই । সেইখানে সন্ধ্যা হইল। কাননে অন্ধকার হইল। আকাশে নক্ষত্র ফুটিল । পুথিবী নীরব হইল । গোবিনদলাল সেইখানে । অকস্মাৎ সেই অন্ধকার, স্তব্ধ বিজনমধ্যে গোবিন্দলালের উন্মাদগ্ৰস্ত চিত্ত বিষম বিকারপ্রাপ্ত হইল। তিনি স্পষ্টাক্ষরে রোহিণীর কণ্ঠস্বর শুনিতে লাগিলেন । রোহিণী উচ্চৈঃস্বরে যেন বলিতেছে— GÉএইখানে” গোবিন্দলালের যখন আর স্মরণ ছিল না যে, রোহিণী মরিয়াছে । তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “এইখানে –কি ?” যেন শুনিলেন, রোহিণী বলিতেছে—

  • এমনি সময়ে” গোবিন্দলাল কলে বলিলেন, “এইখানে, এমনি

সময়ে, কি রোহিণি ?” মানসিক ধ্যাধিগ্রস্ত গোবিন্দলাল শুনিলেন, আবার রোহিণী উত্তর করিল— “এইখানে, এমনি সময়ে, ঐ জলে, আমি ডুবিয়াছিলাম।” গোবিন্দলাল, আপন মানসোদ্ভূত এই বাণী শুনিয়। জিজ্ঞাসা করিলেন—“আমি ডুবিব ?” আবার ব্যাধিজনিত উত্তর শুনিতে পাইলেন, “ছ, আইস । ভ্রমর স্বর্গে বসিয়া বলিয়া পাঠাইতেছে, তাহার পুণ্যবলে আমাদিগের উদ্ধার করিবে । প্রায়শ্চিত্ত কর। মর ” গোবিন্দলাল চক্ষু বুজিলেন । র্তাহার শরীর অবসন্ন, বেপমান হইল। তিনি মূৰ্ছিত হইয়া সোপানশিলার উপরে পতিত হইল । ... :