পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/১৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

লীতারাম s লাগিল, “ধন্ত রায়জী ! ধন্ত রায় মহাশয় ! জয় কাজী-সাহেবক ! গরিবকে ছাড়িয়া দেও !” যাহার কথা কিছুই শুনিতে পায় নাই, তাহারাও হরিধ্বনি দিতে লাগিল । তুমুল কোলাহৰ পড়িয় গেল । কাজী সাহেবও বিস্মিত হইয়া সীতারামকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কি বলিতেছেন, রায় মহাশয় ? এ আপনার কে যে, ইহার জন্য আপনার প্রাণ দিতে চাহিতেছেন ?” সীতা । এ আমার ভ্রাতার অপেক্ষ-পুত্রের অপেক্ষীও আত্মীয়, কেন না, আমার শরণাগত । হিন্দুশাস্ত্রের বিধি এই যে - সৰ্ব্বস্ব দিয়া, শরণ। গতকে রক্ষা করিবে । রাজ উশােনর আপনার শরীরের সকল মাংস কাটিল দিয়া, একটি পায়রাকে রক্ষা করিয়াছিলেন । অতএব আমাকে গ্ৰহণ করুন —ইহাকে ছাড়ন । কাজী সাহেব সীতারামের উপর কিছু প্রসন্ন হইলেন । শাহ সাহেবকে অন্তরালে লইয়। চুপি চুপি কথাবাৰ্ত্ত কহিতে লাগিলেন । বলিলেন, “এ ব্যক্তি দশ হাজার আসরফি দিতে চাহিতেছে । নিলে সরকারী তহবিলের কিছু সুসায় হুইবে । দশ হাজার আসরফি লইয়। এই হতভাগাকে ছাড়িয়া দিলে হয় ন! ?" শাহ-সাহেব বলিলেন, “আমার ইচ্ছ, দুইটাকেই এক কবরে পুতি । আপনি কি বলেন ?” কাঞ্জা ! তেব ! আমি তাহ পারিব না : সীতারাম কোন অপরাপ করে নাই । বিশেষ এ ব্যক্তি মাতৃগণ্য ও সচ্চরিত্র, তা হইবে ন! । এতক্ষণ গঙ্গারাম কোন কথা কহে নাই, মণে জানিত যে, তাহার আর নিয়তি নাই । কিন্তু শাহ সাহেবের সঙ্গে কাঞ্জা সাহেবের নিভৃতে কথা হইতেছে দেখিয় সে যোড়হাত করিয়! কাজী সাহেবকে বলিল, “হুজুরের মরজি মবারকে কি হয়, বলিতে পারি না, কিন্তু এ গরিবের প্রাণরক্ষা সম্বন্ধে গরিবেরও একটা কথ। শুনিতে হয় । একের অপরাধে অষ্ঠের প্রাণ লইবেন, এ কোন সরায় আছে? সাতারামের প্রাণ লইয়া, আমার প্রাণদান দিবেন, আমি এমন প্রাণদান লইব না । এই হাতকড়ি মাথায় মারিয় আপনার মাথ ফাটাইব ।” তখন ভিড়ের ভিতর হইতে কে ডাকিয়া বলিল “হাতকড়ি মাথায় মারিয়াই মর। মুসলমানের হাত এড়াইবে ।” বক্তা স্বয়ং চন্দ্রচূড় ঠাকুর । তিনি আর গাছে নাই। এক জন জমাদার শুনিয়া বলিল “পাকড়ে ওস্কো ।” কিন্তু চন্দ্রচূড় তর্কালঙ্কারকে পাকুড়ান বড় শক্ত কথা । সে কাজ হইল না । এ দিকে হাতকড়ি মাথায়ু মারার কথা শুনিয়া । ফকীর মহাশয়ের কিছু ভয় হইল, পাছে জীয়ন্ত মানুষ , পোতার মুখে তিনি বঞ্চিত হন । কাজী সাহেবকে বলিলেন, “এখন আর উহার হাতকড়িতে প্রয়োজন কি ? হাতকড়ি খসাইতে বলুন ।” কাজী সাহেব সেক্টরূপ হুকুম দিলেন । কামার আসিয়া গঙ্গারামের হাত মুক্ত করিল। কামারের সেখানে উপস্থিত থাকিবীর প্রয়োজন ছিল না, তবে সরকারী বেড়ী, হাতকড়ি সব তাহার জিন্ম, সেই উপলক্ষে সে আসিয়াছিল। তাহার ভিতর কিছু গোপন কথাও ছিল । ৰাত্রিশেষে কৰ্ম্মকাব মহুশির চন্দ্রচূড় ঠাকুরের কিছু টাক খাইয়াছিলেন । , তখন ফকীর বলিল, “আর বিলম্ব কেন ? উহাকে গাড়িয়৷ পোলিত হুকুম দিন ।” শুনিয় কামার বলিল, “বেড়া পারে থাকিবে কি ? সরকারী বেড়া লোক্সান হুইবে কেন ? এখন ভাল লোহু বড় পাওয়া যায় না। আর বদমায়েসেরও এত হুড়াহুড়ি পড়িয়া গিয়াছে যে, আমি আর বেড়ী যোগাইতে পারিতেছি ন " শুনিয় কাজী সাহেব বেড়ী পুলিতে হুকুম দিলেন । বেড়া খোলা হইল। শৃঙ্খল-মুক্ত হুইয়। গঙ্গারাম দাড়াইয়া একবার এদিক ওদিক দেখিল । তার পর গঙ্গারাম এক অদ্ভূত কাজ করিল । নিকটে সীতারাম ছিলেন। ঘোড়ার চাবক তাহার হাতে ছিল । সহসা তাহার হাত হইতে সেই চাবুক কড়িয়া লইয়। গঙ্গারাম এক লম্ফে সীতারামের শৃঙ্গ অশ্বের উপর উঠিস্থ অশ্বকে দারুণ আঘাত করিল। তেজস্বী অশ্ব আঘাতে ক্ষিপ্ত হইয়া এক লম্ফে কবরের খাদ পরে হইয়। সিপাহীদিগের উপর দিয়া চলির গিয়া জনতার ভিতর প্রবেশ করিল। যতক্ষণে একবার বিদ্যুৎ চমকে, ততক্ষণে এই কাজ সম্পন্ন হইল । দেখিয়৷ সেই লোকারণ্যমধ্যে তুমুল হরিধ্বনি পড়িয়া গল । সিপাহীর। “পাকুড়ে পাকৃড়ো” বলিয়৷ পিছু পিছু ছুটিল । কিন্তু তাহাতে একটা ভারী গোলযোগ উপস্থিত হুইল । বেগবান অশ্বের মুখ হইতে লোকে ভয়ে সরিয়! যাইতে লাগিল, গঙ্গারাম পথ • পাইতে লাগিল ; কিন্তু সিপাহীরা পথ পাইল না । তাহাদের সম্মুখে লোক জমাট বাধিয়া দাড়াইল ; তখন তাহার হাতিয়ার চালাইয়া পথ করিবার উদ্যোগ করিল। সেই সময়ে তাহারা সবিস্ময়ে দেখিল যে, কালাস্তক ধমের ন্যায় কতকগুলি বলিষ্ঠ, অস্ত্রধারী পুরুষ একে একে ভিড়ের ভিতর হইতে আসিয়া, সারি দিয়া তাহ৮ দের সম্মুখে পথরোধ করিয়া দাড়াইল । তখন আরও