সীতারাম আমাকে আজ্ঞা করিলেন যে, আমি তোমাকে গ্রহণ বা তোমার সঙ্গে সহবাস না করি । এই কারণে তুমি আমার কাছে সেই অবধি পরিত্যক্ত ।” ঐ দাড়াইয়া উঠিল । কি বলিতে যাইতেছিল, সাঁতারাম তাহাকে ধরিয়া বসাইলেন ; বলিলেন, “আমার কথা বাকী আছে । যখন পিতা বর্তমান ছিলেন—আমি তাহার অধীন ছিলাম--তিনি ষা করাইতেন, তাই হইত ” শ্ৰী । এখন তিনি স্বর্গে গিয়াছেন বলিয়া কি তুমি আর তাহার অধীন নও ? সীতা । পিতার আজ্ঞ সকল সময়েষ্ট পালনীয় —তিনি যখন আছেন, তখনও পালনীয়---তিনি ধখন স্বর্গে, তখনও পালনীয়। কিন্তু পিতা যদি অধৰ্ম্ম করিতে বলেন, তবে তাহ! কি পালনীয় ? পিতা, মাতা বা গুরুর আজ্ঞাতেও অপৰ্ম্ম করা যায় না –কেন ন}, যিনি পিতা-মাতার পিতামাতা এবং গুরুর গুরু, অধৰ্ম্ম করিলে তাহার বিধি লঙ্ঘন করা হয় । বিনাপরাধে স্ত্রীত্যাগ ঘোরতর অপৰ্ম্ম—অতএব আমি পিতৃআজ্ঞা পালন করিয়া অপৰ্ম্ম করিতেছি—শীঘ্রই আমি তোমাকে এ কথা জানাষ্টতাম, কিন্তু— ঐ আবার দাড়াইয়। উঠিল ; বলিল, “আমাকে পরিত্যাগ করিয়াও যে তুমি আমাকে এত দয়া করিয়াছ, আমার ভাইয়ের প্রাণভিক্ষা দিয়াছ, ইহা তোমার অশেষ গুণ । আর কখনও আমি তোমাকে মুখ দেখাইব না ব৷ তুমি কখনও আমার নামও শুনিবে না। গণকঠাকুর যাই বলুন, স্বামী ভিন্ন স্ত্রীলোকের আর কেহই প্রিয় নহে । সহবাস থাকুক বা না থাকুক, স্বামীই স্ত্রীর প্রিয়। তুমি আমার চিরপ্রিয়—এ কথা লুকান আমার আর উচিত নহে । আমি এখন হইতে তোমার শত যোজন তফাতে থাকিব ।” এই বলিয়া ঐ ফিরিয়া না চাহিয়, সেখান হইতে চলিয়া গেল । অন্ধকারে সে কোথায় মিশাইল, সীতারাম আর দেখিতে পাইলেন না । অষ্টম পরিচ্ছেদ তা, কথাটা কি আজ সীতারামের নুতন মনে হইল ? না । কাল ত্রকে দেখিয়া মনে হইয়াছিল। কাল কি প্রথম মনে হুইল ? হুঁ, তা বৈ কি ! সীতারামের সঙ্গে এঁর কতটুকু পরিচয় ? বিবাহের পর কয়দিন দেখা—সে দেখাই নয়—শ্ৰী তখন বড় বালিক । তার পর সীতারাম ক্রমশঃ দুই বিবাহ করিয়াছিলেন । তপ্তকাঞ্চনষ্ঠামাঙ্গী নন্দাকে বিবাহ ; করিয়াও বুঝি খ্রীর খেদ মিটে নাই—তাই তার পিতা আবার ভিমরাশি প্রতিফলিত কৌমুদীরূপিণী রমার সঙ্গে পুলের বিবাহ দিয়াছিলেন । আজ এক জন বসন্তনিকুঞ্জ-প্রস্থলাদিনী অপূর্ণ কলোলিনী ; আর এক জন বর্যাবারিরাশি-প্রমথিত পরিপূর্ণ স্রোতস্বতী । দুই স্রোতে ঐ ভাসিয়া গেল । তার পর আর ঐর কোন খবরক্ট নাই ! স্বীকার করি, তব শ্ৰীকে মনে করা সীতারামের উচিত ছিল । কিন্তু এমন অনেক উচিত কাজ আছে । যে, কাহারও মনে হয় না । মনে হইবার একটা কারণ না ঘটিলে, মনে হয় না । যাহার নিত্য টাকা আসে, সে কবে কোথায় সিকিট আধুলিট হারাষ্টয়াছে, তার তা বড় মনে পড়ে না । যার এক দিকে নন্দা, আর এক দিকে রমা, তার কোথাকার শ্ৰীকে কেন মনে পড়িবে ? যার এক দিকে গঙ্গা, এক দিকে যমুনা, তার কবে কোথায় বালির মধ্যে সরস্বতী শুকাইয়া লুকাইম আছে, তা কি মনে পড়ে ? যার এক দিকে চিত্র, আর এক দিকে চন্দ্র, তার কবে কোথাকার নিবান বাতীর আলো কি মনে পড়ে ? রম সুখ, নন্দ। সম্পদ, শ্ৰী বিপদ –ষার এক দিকে সুখ, আর এক দিকে সম্পদ, তার কি বিপদকে মনে পড়ে ? তবে সে দিন রাত্রিতে ত্রর চাদপান মুখখানা, । ঢলঢল ছল-ছল জলভরা বলহারা চোখ ফুটো, বড় গোল করিয়া গিয়াছে ৷ রূপের মোহ ? অা ছি! ছি ! তা না ! তবে তার রূপেতে, তার তুঃখেতে আর সীতারামের স্বরুত অপরাধে এই তিনটায় মিশিয়া গোলযোগ বাপাইয়াছিল । তা যা হউক—তার একটা বুঝাপড়া হইতে পারিত ; ধীরে সুস্থে সময় বুঝিয়া, কৰ্ত্তব্যাকৰ্ত্তব্য ধৰ্ম্মাধৰ্ম্ম বুঝিয়া, গুরু-পুরোহিত ডাকিয়া পিতার আজ্ঞালঙ্ঘনের একটা প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করিয়া যা হয় না হয় হইত –কিন্তু সেই সিংহবাহিনী মূৰ্ত্তি ! আমরি মরি—এমন কি আর হয়! তবে সীতারামের হইয়। এ কথাটাও আমার বলা কৰ্ত্তব্য যে, কেবল সিংহবাহিনী মূৰ্ত্তি স্মরণ করিয়াই সীতারাম পত্নীত্যাগের অধাৰ্ম্মিকত হৃদয়ঙ্গম করেন নাই। পূৰ্ব্বরাত্রিতে যখনই প্রথম ক্রকে দেখিয়াছিলেন, তখনই মনে হইয়াছিল যে, আমি পিতৃ আজ্ঞা পালন করিতে গিয়া পাপাচরণ করিতেছি । মনে করিাছিলেন যে, আগে স্ত্রীর ভাইয়ের জীবন রক্ষা করিয়া, নন্দারমাকে পূৰ্ব্বেই শান্তভাবাবলম্বন
পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/১৭৩
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।