পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সেই সমস্ত পৌরস্ত্রী জয়ন্তীকে ঘেরিয়া দাড়াইল । মহারাণী নিজে জয়ন্তীকে আড়াল করিয়া তাহার সম্মুখে দাড়াইলেন । দর্শকেরা সকলে করতালি দিয়া হরিবোল দিতে লাগিল । কসাই জয়ন্তীর হাত # ছাড়িয়া দিল ; কিন্তু মঞ্চ হইতে নামিল না । রাজা অত্যন্ত বিস্মিত ও রুষ্ট হইয়। অতি পরুষভাবে নন্দাকে বলিলেন, “এ কি এ মহারাণি ?" নন্দ বলিলেন, “মহারাজ ! আমি পতি-পুত্রবতী, আমি জীবিত থাকিতে তোমাকে কখনও এ পাপ করিতে দিব না, তাহা হইলে আমার কেহ থাকিবে না ।” রাজা পূৰ্ব্ববৎ ক্রুদ্ধভাবে বলিলেন, “তোমার ঠাই অন্তঃপুরে, এখানে নয়। অস্তঃপুরে যাও " নন্দা সে কথায় কোন উত্তর না দিয়। বলিল, “মহারাজ ! আমি যে মঞ্চের উপর দাড়াইয়াছি, এই কসাইট। সেই মঞ্চে দাড়াইয় থাকে কোন সাহসে ? উহাকে নামিতে আজ্ঞ দিন ।” রাজা কথ কহিলেন না । তখন নন্দ। উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন, “এই রাজপুরীর মধ্যে আমার কি এমন কেহ নাই যে, এটাকে নামাইয়। দেয় ?” তখন সহস্র দর্শক এককালে “মার ! মার !" শব্দ করিয়া কসাইয়ের প্রতি ধাবমান হষ্টল । সে লম্ফ দিয়া মঞ্চ হইতে পড়িয়। পলাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু দর্শকগণ তাহাকে ধরিয়। ফেলিয়। মারিতে মারিতে দুর্গের বাহিরে লইয়। গেল । পরে অনেক লাঞ্ছনা করিয়া প্রাণমাত্র রাখিয়। ছাড়িয়। দিল । নন্দ জয়ন্তীকে বলিল, “মা ! দয়। করিয়া অভয় দও ! মা, আমার বড় ভয় হইতেছে, পাছে কোন দেবতা ছলনা করিয়। আসিয় থাকেন । অপরাধ লইও না । একবার অন্তঃপুরে পাসের ধূলা দিবে চল । আমি তোমার পূজা করিণ " তখন রাণী পৌরস্ত্রীগণ সমভিবiাহারে জয়ন্তাকে ঘেরিয়া অন্তঃপুরে লষ্টয়া চলিলেন । রাজ কিছু করিতে না পারিয়৷ সিংহাসন হক্টভে উঠিয় গেলেন । তখন মহাকোলাহলপূৰ্ব্বক এবং নন্দাকে আশীৰ্ব্বাদ করিতে করিতে দর্শকমণ্ডলী দুর্গ হইতে নিষ্ক্রান্ত ম। " হইল । অস্তঃপুরে গিয়া জয়স্তা ক্ষণকালও অবস্থিতি করিল না । নন্দ অনেক অমুনয় করিয়া স্বহস্তে গঙ্গাজলে জয়ন্তীর পা ধুইয়া সিংহাসনে বসাইতে গেলেন । কিন্তু জয়ন্তী হাসিয়া উড়াইরা দিল । বলিল, “মা ! আমি কায়মনোবাক্যে আশীৰ্ব্বাদ করিতেছি, তোমাদের মঙ্গল হউক । বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী . ক্ষণমাত্র জষ্ঠ মনে করিও না ষে, আমি কোন প্রকার রাগ বা দুঃখ করিয়াছি । ঈশ্বর না করুন, কিন্তু যদি কখনও তোমার বিপদ পড়ে, জানিতে পারিলে, আমি আসিয়া তোমার যথাসাধ্য উপকার করিব । কিন্তু রাজপুরীমধ্যে সন্ন্যাসিনীর ঠাই নাই । অতএব আমি চলিলাম !" নন্দ এবং পৌরবর্গ জয়ন্তীর পদধূলি লইয়া তাহাকে বিদায় করিল। উনবিংশ পরিচ্ছেদ রাজবাড়ীর অন্তঃপুরের কথা বাহিরে যায় বটে, কিন্তু কখনও ঠিক ঠিক যায় না । স্ত্রীলোকের মুখে মুখে যে কথাট। চলিয়। চলিয়া রটিতে থাকে, সেট। কাজেই মুখে মুখে বড় বাড়িয়া ধায় । বিশেষ যেখানে একটুখানি বিস্ময়ের গন্ধ থাকে, সেখানে বড় বাড়ির যায়। জয়ন্তী সম্বন্ধে অতি প্রাক্লত রটন। পূৰ্ব্বে যথেষ্টই ছিল, নাগরিকদিগের কথাবাৰ্ত্তীয় আমর। দেখিয়াছি । এখন চয়ন্তী রাজপুরীমধ্যে প্রবেশ করিয়াই বাহির হইয়। চলিয়। গিয়াছিল, এই সক্তি। কথাটা যেরূপে বাহিরে রাটল, ভ{হাতে লোকে বুঝিল যে, দেবী অন্তঃপুরমধ্যে প্রবেশ করিয়াই অন্তৰ্দ্ধান করিলেন আর কেহ তাহাকে দেখিতে পাইল না । কাজেই লোকের দৃঢ় প্রতায় হইল যে, তিনি নগরের অধিষ্ঠাত্রী, রক্ষাকত্ৰী দেবতা, রাজাকে ছলন। করিয়। এক্ষণে ছল পাইয়। রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া গিয়াঢ়েন । অতএব রাজ্য আর থাকিবে না । দুর্ভাগ্যক্রমে এই সময়ে জনরব উঠিল যে, মুর্শিদাবাদ হষ্টতে নবাবী ফৌজ অসিখেছে । কাজেই রাজ্যধ্বংস যে অতি নিকট, সে বিষয়ে আর বেশী লোকের সন্দেহ রহিল ল । তখন নগরের মধ্যে বোচক। লাধিবার বড় ধম পড়িয় | গেল । অনেকেই নগর ত্যাগ করিয়৷ চলিল । সীতারাম এ সকলের কোন সংবাদ ন। রাখিয়। চিত্তবিশ্রামে গিয়া একাকী বাস করিতে লাগিলেন । এখন তাহার চিত্তে ক্রোধই প্রবল-সে ক্রোধ সৰ্ব্ব ব্যাপক, সৰ্ব্বগ্রাসক । অন্তকে ছাড়িয়া, ক্রোধ ক্রীর উপরেই অধিক প্রবল হুইল । উদ্‌ভান্তচিত্তে সীতারাম কতকগুলি নীচব্যবসায়ী নীচাশয় অনুচরবর্গকে আদেশ করিলেন, “রাজ্যে যেখানে যেখানে যে সুন্দরী স্ত্রী আছে, আমার জন্য চিত্ত-বিশ্রামে লইয়া আইস ।” তখন দলে দলে সেই পামরের চারিদিকে ছুটিল । যে অর্থের বশীভূত,