পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

.সাঁতারাম - o f জয়ন্তী’। আর এক দিন তুমি একাই দুর্গ রক্ষা করিয়াছিলে । রাজা । আজ তাহা হয় না । জলে আর তটে অনেক প্রভেদ । পৃথিবীতে এমন মনুষ্য নাই দে, আজ একা দুর্গ রক্ষা করিতে পারে। জয়ন্তী। তোমার ত এখনও পঞ্চাশ জন সিপাহী আছে । - রাজা । ঐ সেনা সকলের, এই পঞ্চাশ জনে কি করিবে ? আমার আপনার প্রাণ আমি যখন ইচ্ছা, যেমন করিয়৷ ইচ্ছা, পরিত্যাগ করিতে পারি ; কিন্তু বিনাপরাধে উহাদিগকে হত্যা করি কেন ? পঞ্চাশ জন লইয়। এ যুদ্ধে মৃত্যু ভিন্ন অন্য কোন ফল নাই । শ্ৰী । মহারাজ ! আমি বা নন্দ মরিতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু নন্দা-রমার কতকগুলি পুল্লকা) আছে, তাহাদের রক্ষার কিছু উপায় হয় না ? সীতারামের চক্ষে জলধার ছুটিল । “নিরুপায় । উপায় কি করিব ?” জয়ন্তী বলিল, “মহারাজ ! নিরুপাসের এক উপায় আছে—আপনি তাহ জানেন না ? জানেন বৈ কি ? জানিভেন, জানিয়া ঐশ্বৰ্য্য-মদে ভুলিয়া গিয়াছিলেন —এখন কি সেই নিরুপায়ের উপায়, অগতির গতিকে মনে পড়ে ন! ?” সীতারাম মুখ নত করিলেন। খন অনেক দিনের পর সেই নিরুপায়ের উপায়, অগস্ক্রির গতিকে মনে পড়িল ৷ কাল-কাদম্বিনী বাতাসে উড়িয়া গেল –হৃদয়ের মধ্যে অল্পে তাল্পে ক্রমে ক্রমে স্বর্যরশ্মি বিকশিত হইভে লাগিল—চিন্ত করিতে করিতে অনন্তব্ৰহ্মাণ্ড প্রকাশক সেই মহাজ্যোতিঃ প্রভাসিত হইল । তখন সীতারাম মনে মনে ডাকিতে লাগিলেন, “নাথ ! দীননাথ ! নিরুপায়ের উপায় ! অগতির গতি । পুণ্যময়ের আশ্রয় : পাপিষ্ঠের পরিত্রাণ ! আমি পাপিষ্ঠ বলিয়া আমায় কি দয়া করিবে না ?” সীতারাম অনন্তমনা হইয়া ঈশ্বরচিন্তা করিতেছেন দেখিয়া ত্রকে জয়ন্তী ইঙ্গিত করিল । তখন সহসা দুই জন সেই মঞ্চের উপর জামু পাতিয়া বসিয়া, দুই হাত যুক্ত করিয়া, উদ্ধনেত্র হইয়া, ডাকিতে লাগিল— গগনবিদারী কলবিহঙ্গনিন্দী কণ্ঠে, সেই মহাদুর্গের চারিদিক প্রতিধ্বনিত করিয়া ডাকিতে লাগিল— “ত্বমাদিদেবঃ পুরুষঃ পুরাণত্বমস্ত বিশ্বস্ত পরং নিধানম্। বেত্তালি বেদ্যঞ্চ পরং চ ধাম, ত্বয়া ততং বিশ্বমনস্তৃরূপ ।” ২যু- ৩০ বলিলেন, ዓ¢ দুর্গের বাহিরে সেই সাগরগর্জনবৎ মুসলমানসেনার কোলাহল ; প্রাচীর-ভেদার্থ প্রক্ষিপ্ত কামনের ভীষণ নিনাদ মাঠে মাঠে, জঙ্গলে জঙ্গলে, নদীর বাকে বাকে প্রতিধ্বনিত হইতেছে—দুর্গমধ্যে জনশূন্ত, সেই প্রতিধ্বনিত কোলাহল ভিন্ন অন্য শব্দশৃঙ্গ— তাহার মধ্যে সেই সাক্ষাৎ জ্ঞান ও ভক্তিরূপিণী জয়ন্তী ও শ্রীর সপ্তস্থর সংবাদিনী আকুলিতকণ্ঠনিঃস্থত মহা গীতি তাকাশ বিদীর্ণ করিয়!, সীতারামের শরীর রোমাঞ্চিত করিয়৷ উৰ্দ্ধে উঠিতে লাগিল— “নমো নমস্তেহস্তু সহস্ৰকৃত্বঃ পুনশ্চ ভূয়োগুপি নমো নমস্তে । নমঃ পুরস্তাদথ পৃষ্ঠতস্তে, নমোহস্থ তে সৰ্ব্বত এব সৰ্ব্ব ।” শুনিতে শুনিতে সীতারাম বিমুগ্ধ হইলেন ;– আসন্ন বিপদ ভুলিয়া গেলেন, যুক্তকরে উৰ্দ্ধমুখে বিহ্বল হইয়া আনন্দাশ্র বিসর্জন করিতে লাগিলেন,~~র্তাহার চিত্ত আবার বিশুদ্ধ হইল। জয়ন্তী ও শ্ৰী সেই আকাশবিপ্লাৰী কণ্ঠে আবীর হরিনাম করিতে লাগিল, হরি ! হরি । হরি হে । হরি ; হরি ! হরি ! হরি হে ! এমন সমর দুর্গমধ্যে মহা কোলাহল হইতে লাগিল । শব্দ শুনা গেল—“জয় মহারাজকি জয় ! জয় সী তারামকি জয় !" দ্বাবিংশতিতম পরিচ্ছেদ পাঠককে বলিতে হইবে না যে, দুর্গমধ্যেই সিপাঠীরা বাস করিত । ইহাও বলা গিয়াছে ষে, সিপাহী সকলেই দুর্গ ছাড়িয়া পলাইয়াছে ; কেবল জন পঞ্চাশ নিতান্ত প্রভুভক্ত ব্রাহ্মণ ও রাজপুত পলায় নাই । তাহারা বাছা বাছ লোক-বাছা বাছা লোক নহিলে এমন সময়ে বিনা বেতনে কেবল প্রাণ দিবার জন্ত পড়িয়া থাকে না । এখন তাহারা বড় অপ্রসর হইয়। উঠিল । এ দিকে মুসলমানসেন আসিয়া পড়িয়াছে, মহা কোলাহল করিতেছে, কামনের ডাকে মেদিনী কঁপাইতেছে, গোলার আঘাতে দুর্গপ্রাচীর ফাটাইতেছে—তবু ইহাদিগকে সাজিতে কেহ হুকুম দেয় না। রাজা নিজে আসিয়া সব দেখিয়া গেলেন । কৈ ? তাহাদের ত সাজিতে হুকুম দিলেন না ! তাহারা কেবল প্রাণ দিবার জন্য পড়িয়া আছে, অন্য পুরস্কার কামনা করে না ; কিন্তু তাও ঘটিয় উঠে না—কেহ ত বলে না, “আইস ।