পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সীতারাম গম্বুজের ভিতরে তাহার ঘোরতর প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল—সেই অশ্বগণের পদধ্বনিও প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল । তখন যবন সেনাসাগরের তরঙ্গাভিঘাতে সেই দুশ্চালনীয় লৌহনিৰ্ম্মিত বৃহৎ কবাট আপনি উদঘাটিত হইল, উন্মুক্ত দ্বারপথ দেখিয়া স্বচিবুহিস্থিত রণবাজিগণ নৃত্য করিতে লাগিল । এ দিকে যেমন বাধ ভাঙ্গিলে বন্যার জল পাৰ্ব্বত্য জলপ্রপাতের মত ভীষণ বেগে প্রবাহিত হয়, মুসলমানসেনা দুৰ্গদ্বার মুক্ত পাইয়া তেমনই বেগে ছুটিল । কিন্তু সম্মুখেই জয়ন্তী ও ত্রকে দেখিয়৷ সেই সেনাতরঙ্গ —সহসা মন্ত্রমুগ্ধ ভুজঙ্গের মত যেন নিশ্চল হইল । যেমন বিশ্বমোহিনী দেবীমূৰ্ত্তি, তেমনই অদ্ভুত বেশ, তেমনই অদ্ভুত, অশ্রুতপূৰ্ব্ব সাহস, তেমনই সৰ্ব্বজনমনোমুগ্ধকারী সেই জয়গীতি!—মুসলমানসেন। তাহাদিগকে পুররক্ষাকারিণী দেবী মনে করিয়া সভয়ে পথ ছাড়িয়া দিলেন । তাহারা ত্ৰিশূলের ফলকের দ্বারা পথ পরিষ্কার করিয়া, যবন-সেনা ভেদ করিয়৷ চলিল । সেই ত্রিশূলমুক্ত পথে সীতারামের স্থচিবৃহ অবলীলাক্রমে মুসলমানসেন। ভেদ করিয়া চলিল । এখন সাতারামের অন্তঃকরণে জগদীশ্বর ভিন্ন আর কেহ নাই ! এখন কেবল ইচ্ছা, জগদীশ্বর স্মরণ করিয়া তাহার নিদেশবৰ্ত্তী হইয়া মরিবেন । তাই সীতাবাম চিন্তাশূন্ত, অবিচলিত, কার্যে অভ্রান্ত, প্রফুল্লচিত্ত, হাস্তবদন সীতারাম ভৈরবীমুখে হরিনাম শুনিয়া শ্ৰীহরি স্মরণ করিয়া আত্মজী হইয়াছেন, এখন ঠার কাছে মুসলমান কোন ছার ! তার প্রফুল্লকান্তি এবং সামান্ত অথচ জয়শালিনী সেনা দেখিয়া মুসলমান-সেন। ‘মার মার শব্দে গর্জিয়া উঠিল । স্ত্রীলোক দুই জনকে কেহ কিছু বলিল না —সকলেই পথ ছাড়িয়া দিল । কিন্তু সীতারাম ও তাহার সিপাহীগণকে চারি দিক্ হইতে আক্রমণ করিতে লাগিল । কিন্তু সীতারামের সৈনিকের র্তাহার আজ্ঞানুসারে, কোথাও ভিলাৰ্দ্ধ দাড়াইয়া যুদ্ধ করিল না—কেবল অগ্রবর্তী হইতে লাগিল । অনেকে মুসলমানের আঘাতে আহত হইল—অনেকে নিহত হইয়া ঘোড় হইতে পড়িয়া গেল, অমনই অর এক জন পশ্চাৎ হইতে তাহার স্থান গ্রহণ করিতে লাগিল। এইরূপে সীতারামের স্থচিয়ূহ অভগ্ন থাকিয়া ক্রমশঃ মুসলমান-সেনার মধ্যস্থল ভেদ করিয়া চলিল, সম্মুখে জয়ন্তী ও ঐ পথ করিয়া চলিল। সিপাহীদিগের উপর যে আক্রমণ হইতে লাগিল, তাহা ভয়ানক ; কিন্তু সীতারামের দৃষ্টান্তে, উৎসাহবাক্যে, অধ্যবসায় এবং শিক্ষার প্রভাবে তাহারা সকল বিঘ্ন •জয় করিয়া ጫማል চলিল। পাশ্বে দৃষ্টি না করিয়া, যে সম্মুখে গতিরোধ করে, তাহাকেই আহত, নিহত, অশ্বচরণ-বিদলিত করিয়! সম্মুখে তাহার অগ্রসর হইতে লাগিল । এই অদ্ভুত ব্যাপার দেখিয়া, মুসলমান-সেনাপতি সীতারামের গতিরোধ জন্য একটা কামান স্থচিবুহের সম্মুখদিকে পাঠাইলেন । ইতিপূৰ্ব্বেই মুসলমানেরা দুর্গপ্রাচীর ভগ্ন করিবার জন্য কামানসকল তদুপযুক্ত স্থানে পাতিরাছিল, এজন্য স্থটবুহের সম্মুখে হঠাৎ কামান আনিয়া উপস্থিত করিতে পারে নাই । এক্ষণে রাজা-রাণী পলাইতেছে জানিতে পারিয়া, বহু কষ্টে ও স্বত্নে একটা কামান তুলিয়া লইয়া সেনাপতি স্থচিবুহের সম্মুখে পাঠাইলেন। নিজে সে দিকে যাইতে পারিলেন না । কেন না, দুৰ্গদ্বার মুক্ত পাইয়া অধিকাংশ সৈন্স লুঠের লোভে সেই দিকে যাইতেছে। সুতরাং তাহাকেও সেই দিকে মাইতে হুইল—সুবাদারের প্রাপ্য রাজভাণ্ডার পাচ জনে লুঠিয়া না আত্মসাৎ করে । কামান আসিয়া সীতারামের স্থচিবৃহের সম্মুখে পৌঁছিল। দেখিয়া, সীতারামের পক্ষের সকলে প্রমাদ গণিল । কিন্তু ঐ প্রমাদ গণিল ন! । শ্রী জয়ন্তী দুই জনে দ্রুতপদে অগ্রসর হইয়া কামানের সম্মুখে আসিল । ঐ জয়ন্তীর মুখ চাহিয়৷ হাসিয়া, কামানের মুখে আপনার বক্ষ স্থাপন করিয়া, চারিদিক্‌ চাহিয়া ঈষৎ, মুদ্র, প্রফুল্ল, জয়স্থঢ়ক হাসি হাসিল । জয়ন্তীও ত্রর মুখপানে চাহিয়া, তার পর গোলন্দাজের মুখপানে চাহিয়৷ সেইরূপ হাসি হাসিল--দুই জনে ষেন বলাবলি করিল, -—“তোপ জিতিয়া লইয়াছি " দেখিয়! শুনিয়া" গোলন্দাজ হাতের পলিতা ফেলিরা দিয়া, বিনীতভাবে : তোপ হইতে তফাতে দাড়াইল । সেই অবসরে সাতারাম লাফ দিয়া আসিয়া তাহাকে কাটিয়া ফেলিবার জন্য তরবারি উঠাইলেন । জয়ন্তী অমনি চীৎকার করিল, “কি কর ! কি কর । মহারাজ ! . রক্ষা কর ” “শক্রকে আবার রক্ষ! কি ?” বলিয়া সীতারাম সেই উখিত তরবারির আঘাতে গোলন্দাজের মাথ। কাটিয়। ফেলিয়া তোপ দখল করিয়া লইলেন । দখল করিয়াই ক্ষিপ্ৰহস্ত, অদ্বিতীয় শিক্ষায় শিক্ষিত সীতারাম সেই তোপ ফিরাইয়া আপনার স্বচিবুহের জন্য পথ সাফ করিতে লাগিলেন। সীতারামের হাতের তোপ প্রলয়কালের মেঘের মত বিরামশ্বন্ত গভীর গর্জন আরম্ভ করিল। তদ্বর্ষিত অনন্ত লৌহপিণ্ডশ্রেণীর আঘাতে মুসলমানসেন। ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইয়া সম্মুখ ছাড়িয়া চারিদিকে পলাইতে লাগিল । স্বচিবুহের পথ সাফ ! তখন সীতারাম