পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

** ○ রত্ন তাহার পাদপদ্মে উপহার দিব, তাই ভাবিতে ভাবিতে যাইতেছিলাম—অকস্মাৎ কি বজ্রাঘাত ! সৰ্ব্বালঙ্কার কাড়িয়া লইয়াছে—লউক ; জীর্ণ মলিন দুৰ্গন্ধ বস্ত্র পরাইয়াছে—পরাক্‌ ; বাঘ-ভালুকের মুখে সমৰ্পণ করিয়া গিয়াছে—যাক্ ; ক্ষুধাতৃষ্ণায় প্রাণ ধাইতেছে, তা যাকৃ—প্রাণ অার চাহি না, এখন গেলেই ভাল ;–কিন্তু যদি প্রাণ না যায়, যদি বঁচি, তবে কোথায় যাইব ? আর ত তাকে দেখা হুইল না ! বাপ-মাকেও বুঝি দেখিতে পাইব না । কঁাদিলেও ত কান্না ফুরায় না । তাই কঁাদিব না বলিয়া স্থির করিতেছিলাম । চক্ষুর জল কিছুতেই থামিতেছিল না তবু চেষ্টা করিতেছিলাম—এমন সময় দূরে একটা বিকট গর্জন হইল। মনে করিলাম বাঘ। মনে একটু আহলাদ হইল । বাঘে খাইলে সকল জালা জুড়ায় ৷ হাড়গোড় ভাঙ্গিয় রক্ত শুরিয়া খাইবে, ভাবিলাম, তাও সহ্য করিব, শরীরের কষ্ট বৈ ত না । মরিতে পাইব, সেও পরম স্বখ । অতএব কান্না বন্ধ করিয়া একটু প্রফুল্ল হইয়া স্থির রহিলাম, বাঘের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম । পাতার যত বার ঘস ঘস শব্দ হয়, তত বার মনে করি, ঐ সৰ্ব্বদু:খহর প্রাণস্নিগ্ধকর বাঘ আসিতেছে । কিন্তু অনেক রাত্রি হইল, তবুও বাঘ আসিল না। হতাশ হইলাম। তখন মনে হইল—যেখানে বড় ঝোপজঙ্গল, সেইখানে সাপ থাকিতে পারে । সাপের ঘাড়ে পা দিবার আশায় সেই জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিলাম, তাহার ভিতরে কত বেড়াইলাম । হায় ! মনুষ্য দেখিলে সকলেই পলায়—বনমধ্যে কত সরু সর ঝটপট শব্দ শুনিলাম, কিন্তু সাপের ঘাড়ে ত পা পড়িল না। আমার পায়ে অনেক র্কাট ফুটিল, অনেক বিছুটি লাগিল, কিন্তু কৈ, সাপে ত কামড়াইল না ? আবার হতাশ হইয়। ফিরিয়া আসিলাম, ক্ষুধাতৃষ্ণাস ক্লাস্ত হইয়াছিলাম—আর বেড়াইতে পারিলাম না । একটা পরিস্কার স্তান দেখিয়া বসিলাম । সহস সম্মুখে এক ভালুক উপস্থিত হইল—মনে করিলাম, ভালুকের হাতেই মরিব, ভলুকটাকে তাড়া করিয়। মারিতে গেলাম, কিন্তু হায়! ভালুকটা আমায় কিছু বলিল না । সে গিয়া এক বৃক্ষে উঠিল । বৃক্ষের উপর হইতে কিছু পরে ঝনঝন্‌ করিয়া সহস্র মক্ষিকার শব্দ হইল । বুঝিলাম, এই বৃক্ষে মৌচাক আছে, ভালুক জানিত, মধু লুঠিবার লোভে আমায় ত্যাগ করিল ? শেষ রাত্রিতে একটু নিদ্র। আসিল—বসিয়া বসিয়া গাছে হেলান দিয়া আমি ঘুমাইয়া পড়িলাম । বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী চতুর্থ পরিচ্ছেদ এখন যাই কোথায় ? যখন আমার ঘুম ভাঙ্গিল, তখন কাককোকিল ডাকিতেছে—বাশের পাতার পাতার ভিতর দিয়া টুকরা রৌদ্র আসিয়া পৃথিবীকে মণি-মুক্তায় সাজইয়াছে । আলোতে প্রথমেই দেখিলাম, আমার হাতে কিছুই নাই, দস্থ্যর প্রকোষ্ঠালঙ্কার সকল কাড়িয়া লইয়া বিধবা সাজাইয়াছে। বা হাতে এক টুকরা লৌহ আছে—কিন্তু দাহিন হাতে কিছুই নাই । কাদিতে কঁাদিতে একটু লতা ছিড়িয়া দাহিন হাতে বাধিলাম । তার পর চারিদিক্‌ চাহিয়া দেখিতে পাইলাম যে, আমি যেখানে বসিয়াছিলাম, তাহার নিকটে অনেকগুলি গাছের ডাল কাটা, কোন গাছ সমূলে ছিন্ন, কেবল শাখা পড়িয়া আছে । ভাবিলাম, এখানে আসিয়া থাকে। তবে গ্রামে, যাইবার পথ আছে। দিবার আলোক দেখিয়া আবার বাচিবার ইচ্ছা হইয়া—আবার অাশার উদয় হইয়াছিল ; উনিশ বৎসর বৈ ত নয় ! সন্ধান করিতে করিতে একটা অতি অস্পষ্ট পথের রেখা দেখিতে পাইলাম। তাই ধরিয়া চলিলাম। যাইতে যাইতে পথের রেখ। আরও স্পষ্ট হইল, ভরসা হইল, গ্রাম পাইব । তখন আর এক বিপদ মনে হইল-—গ্রামে যাওয়৷ হইবে না । যে ছেড়ামুড়া কাপড়টুকু ডাকাইতের আমাকে পরাইয়া দিয়া গিয়াছিল, তাহাতে কোনমতে কোমর হইতে ঠাটু পর্যন্ত ঢাকা পড়ে আমার বুকে কাপড় নাই । কেমন করিয়৷ লোকালয়ে কালামুখ দেখাইব ? যাওয়৷ ষ্টবে না—এইখানে মরিতে হইবে, ইহাই স্থির করিলাম । কিন্তু পৃথিবীতে রবি রশ্মি প্রভাসিত দেখিয়া, পক্ষিগণের কলকূজন শুনিয়া, লতায় লতায় পুষ্পরাশি দুলিতেছে দেখিয়া, আবার বাঢ়িবার ইচ্ছা প্রবল হইল । তখন গাছ হইতে কতকগুলি পাতা ছিড়িয়া গাথিয়া তাহা কোমরে ও গলায় ছোট দিয়া বাধিলাম । একরকম লজ্জানিবারণ হইল, কিন্তু পাগলের মত দেখাইতে লাগিল । তখন সেই পথ ধরিয়া চলিলাম । যাইতে যাইতে গোরুর ডাক শুনিতে পাইলাম । বুঝিলাম, গ্রাম নিকট । কিন্তু আর চলিতে পারি না । কখনও চলা অভ্যাস নাই। তার পর সমস্ত রাত্রি জাগরণ, রাত্রির সেই অসহ মানসিক ও শারীরিক কষ্ট, ক্ষুধাতৃষ্ণায়