পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

of ১৪ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কলিকাতায় কোন জায়গায় তাহার বাসা ?” .. তাহ আমি কিছুই জানিতাম না—আমি জানিতাম, যেমন মহেশপুর একখানি গওগ্রাম, কলিকাতা তেমনই একখানি গওগ্রাম মাত্র, এক জন ভদ্রলোকের নাম করিলেই লোকে বলিয়া দিবে। এখন দেখিলাম যে, কলিকাতা অনন্ত অট্টালিকার সমুদ্রবিশেষ । আমার জ্ঞাতি খুড়াকে সন্ধান করিবার কোন উপায় দেখিলাম না । কৃষ্ণদাস বাবু আমার হইয়া সন্ধান করিলেন, কিন্তু কলিকাতায় এক জন সামান্য গ্ৰাম্য লোকের ওরূপ সন্ধান করিলে কি হইবে ? * কৃষ্ণদাস বাবু কালীর পূজা দিয়া কাশী যাইবেন, কল্পনা ছিল। পূজা দেওয়া হইল, এক্ষণে সপরিবারে - কাশী যাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন । আমি কাদিতে লাগিলাম। র্তাহার পত্নী কহিলেন, “তুমি আমার কথা শুন । এখন কাহারও বাড়ীতে দাসীপনা কর। আজ সুবি আসিবার কথা আছে, তাকে বলিয়া দিব, তাদের বাড়ীতে তোমায় চাকরাণী রাখিবে ।” আমি শুনিয়া আছড়াইয়া পড়িয়া উচ্চৈঃস্বরে কাদিতে লাগিলাম । শেষ কি কপালে দাসীপনা ছিল ? অামার ঠোট কাটিয়া রক্ত পড়িতেছিল । কৃষ্ণদাস বাবুর দয়া হইল সন্দেহ নাই ; কিন্তু তিনি বলিলেন, “আমি কি করিব ?” সে কথা সত্য— তিনি কি করিবেন ? আমার কপাল । আমি একটা ঘরের ভিতর গিয়া কোণে পড়িয়া কাদিতে লাগিলাম। সন্ধ্যার অল্প পূৰ্ব্বে কৃষ্ণদাস বাবুর গিল্পী আমাকে ডাকিলেন । আমি বাহির হইয়া তাহার কাছে গেলাম । তিনি বলিলেন, “এই স্ববো এয়েছে। তুমি যদি ওদের বাড়ী ঝি থাক, তবে বলিয়া দিই।" ঝি থাকিব না, না খাইয়া মরিব, সে কথা ত স্থির করিয়াছি,–কিন্তু এখনকার সে কথ। নহে— এখন একবার স্ববোকে দেখিয়া লইলাম । “সুবো” শুনিয়া অামি ভাবিয়া রাখিয়াছিলাম যে, “সাহেবসুবো” দরের একটা কি জিনিস—আমি তখন পাড়াগেয়ে মেয়ে । দেখিলাম, তা নয়—একটি স্ত্রীলোক— দেখিবার মত সামগ্ৰী । অনেক দিন এমন ভাল সামগ্রী কিছু দেখি নাই । মানুষটি আমারই বয়সী হইবে, রঙ্গ আমা অপেক্ষা যে ফরস, তাও নয় । বেশ-ভূষা এমন কিছু নয়। কালে গোটকতক মাকৃড়ি, হাতে বালা, গলায় চিক, একখানা কালাপেড়ে কাপড় পরা। তাতেই দেখিবার সামগ্রী । এমন বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী মুখ দেখি নাই ! যেন পদ্মটি ফুটিয়া আছে চারিদিক হইতে সাপের মত কোকড় চুলগুলা ফণা তুলিয়া পদ্মটা ঘেরিয়াছে। খুব বড় বড় চোখ-কখন স্থির, কখন হাসিতেছে। ঠোট দুখানি পাতলা, রাঙ্গা, টক্‌টকে, ফুলের পাপড়ির মত উলুটান, মুখখানি ছোট ; সৰ্ব্বশুদ্ধ যেন একটি ফুটন্ত ফুল। গড়নপিটন কি রকম, তাহ ধরিতে পারিলাম না। আমগাছের যে ডাল কচিয়া যায়, সে ডাল যেমন বাতাসে খেলে, সেই রকম তাহার সৰ্ব্বাঙ্গ খেলিতে লাগিল— যেমন নদীতে ঢেউ খেলে, তাহার শরীরে তেমনই কি একটা খেলিতে লাগিল—আমি কিছু ধরিতে পারিলাম না, তার মুখে কি একটা যেন মাখান ছিল, তাহাতে আমাকে যাদু করিয়া ফেলিল । পাঠককে স্মরণ করিয়া দিতে হইবে না যে, আমি পুরুষমানুষ নহি—মেয়েমানুষ—নিজেও এক দিন একটু সৌন্দৰ্য্যগৰ্ব্বিত ছিলাম। সুবোর সঙ্গে একটি তিন বছরের ছেলে—সেটিও তেমনি একটি অধিফুটন্ত ফুল ! উঠিতেছে, বসিতেছে, খেলিতেছে, হেলিতেছে, দুলিতেছে, নাচিতেছে, দৌড়াইতেছে, হাসিতেছে, বকিতেছে, মারিতেছে, সকলকে আদর করিতেছে । আমি অনিমেষলোচনে সুবোকে ও তার ছেলেকে দেখিতেছি, দেখিয়া কৃষ্ণদাস বাবুর গৃহিণী চটিয়া উঠিয়৷ বলিলেন—“কথার উত্তর দাও না যে,—ভাব কি ?" আমি জিজ্ঞাস করিলাম,—“উনি কে ?” গৃহিণী ঠাকুরাণী ধমকাইয়া বলিলেন, “তাও কি বলিয়া দিতে হইবে ? ও সুবো, আর কে ?” তখন স্থবে। একটু হাসিয়। বলিল, “ত মসীম, একটু বলিয়া দিতে হয় বৈ কি, উনি নুতন লোক, আমায় ত চেনেন না ।" এই বলিয়া স্ববো আমার মুখপানে চাহিয়া বলিল, “আমার নাম সুভাষিণী গো—ইনি আমার মাসীমা, আমাকে ছেলেবেলা থেকে ওঁরা সুবো বলেন " তার পর কথার স্বত্রটা গৃহিণী নিজ হস্তে তুলিয়া লইলেন । বলিলেন, “কলিকাতার রামরাম দত্তের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে । তারা বড় বড়মানুষ। ছেলেবেলা থেকে ও শ্বশুরবাড়ীই থাকে—আমরা কখন দেখিতে পাই না। আমি কালীঘাটে এসেছি শুনে আমাকে একবার দেখা দিতে এসেছে। ওরা বড়মানুষ । বড়মানুষের বাড়ী তুমি কাজকৰ্ম্ম করিতে পারিবে ত ?” আমি হরমোহন দত্তের মেয়ে, টাকার গদিতে শুইতে চাহিয়াছিলাম—আমি বড়মামুষের বাড়ী কাজ করিতে পারিব ত? আমার চোখে জলও আসিল ;