পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

s S}o ভোগ করিয়া লই । তাই প্রাণ ভরিয়া পতিসেব করিতেছিলাম। ইহাতে কি পরিমাণে সুখী হইতেছিলাম, তা তোমরা কেহ বুঝিবে, কেহ বুঝিবে না । পুরুষ পাঠককে দয়া করিয়া কেবল হাসি চাহনির তত্ত্বটা বুঝাইব । ষে বুদ্ধি কেবল কলেজের পরীক্ষা দিলেই সীমাপ্রান্তে পৌঁছে, ওকালতিতে দশ টাকা আনিতে পারিলেই বিশ্ববিজয়িনী প্রতিভা বলিয়া স্বীকৃত হয়, যাহার অভাবই রাজদ্বারে সম্মানিত, সে বুদ্ধির ভিতর পতিভক্তিতত্ত্ব প্রবেশ করান যাইতে পারে না। যাহারা বলে, বিধবার বিবাহ দাও, ধেড়ে মেয়ে পুরুষমানুষের মত নানা শাস্ত্রে পণ্ডিত কর, তাহারা পতিভক্তিতত্ত্ব বুঝিবে কি ? তবে হাসি চাহনির তত্ত্বট যে দয়া করিয়া বুঝাইব বলিয়াছি, তার কারণ, সেটা বড় মোট কথা । যেমন মাহত অন্ধুশের দ্বারা হাতীকে বশ করে, কোচম্যান ঘোড়াকে চাবুকের দ্বারা বশ করে, রাখাল গোরুকে পাচনবাড়ী দ্বারা বশ করে, ইংরেজ যেমন চোখ রাঙ্গাইয়া বাবুর দল বশ করে, আমরা তেমনই হাসি-চাহনিতে তোমাদের বশ করি । আমাদিগের পতিভক্তি আমাদের গুণ, আমাদিগের ষে হাসি-চাহুনির কদর্য্য কলঙ্কে কলঙ্কিত হইতে হয়, সে তোমাদের দোষ । তোমরা বলিবে, এ অত্যন্ত অহঙ্কারের কথা । তা বটে—আমরাও মাটীর কলসী, ফুলের ভিতর ফাটিয়া যাই । আমার এ অহঙ্কারের ফল হাতে হাতে পাইতেছিলাম। যে ঠাকুরটির অঙ্গ নাই, অথচ ধনুৰ্ব্বাণ আছে, মা-বাপ নাই, * অথচ স্ত্রী আছে—ফুলের বাণ, অথচ তাহাতে পৰ্ব্বতও বিদীর্ণ হয় ; সেই দেবতা স্ত্রী-জাতির গৰ্ব্বখর্বকারী ! আমি আপনার হাসিচাহনির ফঁাদে পরকে ধরিতে গিয়া পরকেও ধরিলাম, আপনিও ধরা পড়িলাম। আগুন ছড়াইতে গিয়া পরকেও পোড়াইলাম, আপনিও পুড়িলাম ; হোলির দিনে আবীরখেলার মত, পরকে রাঙ্গা করিতে গিয়া আপনি অনুরাগে রাঙ্গ হইয়া গেলাম । বলিয়াছি, র্তাহার রূপ—মনোহর রূপ—তাতে আবার জানিয়াছি, .যার এ রূপরাশি, তিনি আমারই সামগ্ৰী ;– তাহারই সোহাগে, আমি সোহাগিনী, রূপসী তাহারই রূপে । , তার পর এই আগুনের ছড়াছড়ি! আমি হাসিতে জানি, হাসির কি উতোর নাই ? আমি চাহিতে জানি, চাহনির কি পাল্টা চাহনি নাই ? আমার অধরোষ্ট দূর হইতে চুম্বনাকাজায় ফুলিয়া ক আত্মলোনি থাকে, ফুলের কুঁড়ি পাপড়ি খুলিয়া ফুটিয়া থাকে। র্তাহার" প্রফুল্ল রক্তপুষ্পতুল্য কোমল অধরোষ্ঠ কি তেমনি করিয়া ফুটিয়া উঠিয়া পাপড়ি খুলিয়া আমার দিকে ফিরিতে জানে না ? আমি যদি তাহার হাসিতে, র্তার চাহনিতে, তার চুম্বনাকাঙ্ক্ষায়, এতটুকু ইন্দ্রিয়াকাজক্ষার লক্ষণ দেখিতাম, তবে আমিই জয়ী হইতাম । তাহা নহে । সে হাসি, সে চাহনি, সে অধরোষ্ঠবিস্ফুরণে কেবল স্নেহ, অপরিমিত ভালবাসা । কাজেই আমি হারিলাম । হারিয়া স্বীকার করিলাম যে, ইহাই পৃথিবীর ষোল আন সুখ । যে দেবতা ইহার সঙ্গে বিবাহের সম্বন্ধ ঘটাইয়াছে, তাহার নিজের দেহ যে ছাই হইয়া গিয়াছে, খুব হইয়াছে । পরীক্ষার কাল পূর্ণ হইয়া আসিল, কিন্তু আমি র্তাহার ভালবাসার এমনই অধীন হইয়া পড়িয়াছিলাম যে, মনে মনে স্থির করিলাম, পরীক্ষার কাল তাতীত হইলে তিনি আমাকে মারিয়া ভাড়াইয়া দিলেও যাইব ন। পরিণামে তিনি আমার পরিচয় পাইয়াও যদি আমাকে স্ত্রী বলিয়া গ্ৰহণ না করেন, গণিকার মতও যদি তাহার কাছে থাকিতে হয়, তাহাও থাকিব, স্বামী পাইলে লোকলজ্জাকে ভয় করিব ন| কিন্তু যদি কপালে তা-ও না ঘটে, এই ভয়ে অবসর পাইলেই কাদিতে বসিতাম । কিন্তু ইহাও বুঝিলাম যে, প্রাণনাথের পক্ষচ্ছেদ হইয়াছে । আর উড়িবার শক্তি নাই । তাহার অনুরাগানলে অপরিমিত প্লুতাহুতি পড়িতেছিল । তিনি এখন অনন্তকৰ্ম্ম হইয়া কেবল তামার মুখপানে চাহিয়া থাকিতেন । আমি গৃহকৰ্ম্ম করিতাম—তিনি বালকের মত আমার সঙ্গে সঙ্গে বেড়াইতেন । র্তাহার চিত্তের দুৰ্দ্দমনীয় বেগ প্রতিপদে দেখিতে পাইতাম, অথচ আমার ইঙ্গিতমাত্রে স্থির হইতেন । কখন কখন আমার চরণস্পর্শ করিয়া রোদন করিতেন, বলিতেন, “আমি ঐ অষ্টাহ তোমার কথা পালন করিব—তুমি আমায় ত্যাগ করিয়া যাইও না ।” ফলে আমি দেখিলাম যে, আমি তাহাকে ত্যাগ করিলে তাহার দশা বড় মন হইবে । পরীক্ষা ফাসিয়া গেল। অষ্টাহ অতীত হইলে বিনা বাক্যব্যয়ে উভয়ে উভয়ের অধীন হইলাম । তিনি আমার কুলটা বলিয়া জানিলেন । তাহাও সহ্য করিলাম । কিন্তু আমি যাই হুই, হাতীর পায়ে শিকল পরাইয়াছি, ইহা বুঝিলাম ।