পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাস্তবিক মা ডাকিতেছিলেন । কামিনী মা'র কাছ হইতে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, *জান,-কেন মা ডাকিতং ? তোমার আর দুদিন থাকিতং, যদি না থাকিতং, তবে জোর ক’রে রাথিতং ” আমরা পরস্পরের মুখপানে চাহিলাম । কামিনী বলিল, “কেন পরস্পর তাকিতং ?” উ-বাবু বলিলেন, “ভাবিতং ” কামিনী বলিল, “বাড়ী গিয়া ভাবিতং ! এখন দুই দিন এখানে থাকিতং, দাবিতং, হাসিতং, খুসিতং খেলিতং, ধুলিতং, হেলিতং, দুলিতং, নচিতং গায়িতং ” উ-বাবু বলিলেন, “কামিনী, তুই নাচবি ?" কামিনী । দুর, আমি কেন ? আমি যে শিকল কিনে রেখেছি—তুমি নাচবে । উবাবু। আমাকে ত আসা পর্য্যন্ত নাচাচ্ছ, আর কত নাচাবে—আজ তুমি একটু নাচবে । কামিনী । তা হ’লে থাকিবে ? উ বাবু থাকিব । কামিনীর নাচ দেখিবার প্রত্যাশায় নহে, আমার পিতামাতার অনুরোধে উ-বাবু আর এক দিন থাকিতে সন্মত হইলেন । সে দিনও বড় আনন্দে গেল । দলে দলে পাড়ার মেয়ে আসিয়া সন্ধ্যার পর আমার স্বামীকে ঘেরিয়া লইয়া মজলিস করিয়৷ বসিল । সেই প্রকাণ্ড পুরীর একটা কোণের ঘরে মেয়েদের মজলিস হইল । কত মেয়ে আসিল, তাহার সংখ্য নাই । কত বড় বড় পটল চেরা, ভ্রমর তার চোখ সারি বধিয়া স্বচ্ছ সরোবরে সফরার মত খেলিতে লাগিল । কত কালো কালে কুণ্ডলীকর ফণাধরা অলকরাশি বর্ষা কালের বনের লতার মত ঘুরিয়া ঘুরিরা, ফুলিয়া ফুলিয়া, জুলিয়া দুলিয়া উঠিতে লাগিল-যেন কালিয়: দমনে কালনাগিনীর দলে, বিত্রস্ত হইয়। যমুনার জলে ঘুরিতে ফিরিতেছে-কত কান, কানবাল, চোঁদান, মাকড়ি, ঝুমকা, ইয়ারিং, ফুল-মেঘমধ্যে বিদ্যুতের মত, কত মেঘের মত চুলের রাশির ভিতর হইতে খেলিতে লাগিল—রাঙ্গা ঠোটের ভিতর হইতে কত মুক্তাপংক্তির মত দস্তশ্রেণীতে কত সুগন্ধি তাম্বুলচৰ্ব্বণে কত রকম অধরলীলার তরঙ্গ উঠিতে লাগিল,— কত প্রৌঢ়ার ফাদিনথের ফাদে, কন্দপঠাকুর পর পড়িয়া তীরন্দাজীতে জবাব দিয়া নিস্কৃতি পাইলেন— কত অলঙ্কাররাশিভূষিত সুগোল বাহুর উৎক্ষেপবিক্ষেপে বায়ুসস্তাড়িত পুষ্পিত লতাপূর্ণ উদ্যানের মত সেই কক্ষ একটা অলৌকিক চঞ্চল শোভায় শোভিত বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী হইতে লাগিল ; রুণু রুণু ঝুণু ঝুণু শিঞ্জিতে ভ্রমরগুঞ্জন অনুকৃত হইতে লাগিল ; কত চিকে চিক্‌চিক্‌, হারে বাহার, চন্দ্রহারে চন্দ্রের হার, মলেৰু ঝলমলে চরণ টলমল ! কত বারাণসী, বালুচরী, মুজাপুরী, ঢাকাই, শাস্তিপুরে, সিমলা, ফরাসডাঙ্গ৮–চেলি, গরদ, স্থতা, রঙ্গ করা ডুরে ফুরফুরে, বাদুরে—তাতে কারো ঘোমটা, কারো অাধঘোমটা—কারো কেবল কবরীপ্রাস্তে মাত্র বসনসংস্পর্শ–কারো তাতেও ভুল। আমার প্রাণনাথ গোরার পল্টন ফতে করিয়া ঘরে টাকা লইয়া আসিয়াছেন—অনেক কর্ণেল জাদূরেলের বুদ্ধিভ্রংশ করিয়া লাভের অংশ ঘরে লইয়া আসিয়াছেন–কিন্তু সুন্দরীর পল্টন দেখিয়া তিনি বিশুষ্ক ও বিত্রস্ত । তোপের আগুনের স্থানে নয়ন-বহ্নির ফুৰ্ত্তি, কামানের কালকরাল কুণ্ডলীরুত ধূমপুঞ্জের পরিবর্তে এই কাল করাল কুণ্ডলীকৃত কমনীয় কেশকাদম্বিনী, বেওনেটের ঠনঠনির পরিবর্তে এই অলঙ্কারের রুণরুণি, জয়ঢাকের বাদ্যের পরিবর্তে আলতাপর পায়ে মলের ঝম্‌ঝমি ! যে পুরুষ চিলিওয়ানওয়াল দেখিয়াছে—সেও হতাশ্বাস । এ ঘোর রণক্ষেত্রে তাহাকে রক্ষা করিবার জন্য তিনি আমাকে দ্বারদেশে দেখিতে পাইয়া ইঙ্গিতে ডাকিলেন, কিন্তু আমিও শিখসেনাপতির মত বিশ্বাসঘাতকত করিলাম । এ রণে র্তাহার সাহায্য করিলাম না । স্থল কথা, এই সকল মজলিসগুলায় অনেক লিনজ ব্যাপার ঘটিয়া থাকে জানিতাম । তাই কামিনী আর আমি গেলাম ন| —বাহিরে রহিলাম । দ্বার হইতে মধ্যে মধ্যে উকি মারিতে লাগিলাম । যদি বল, সাহাতে মিল্লজ ব্যাপার ঘটে, তুমি তাহার বর্ণনায় কেন প্রবৃত্ত ? তাহাতে আমার উত্তর এই যে, আমি হিন্দুর মেয়ে, আমার রুচিতে এই সকল ব্যাপার নিল্লজ ব্যাপার, কিন্তু এখনকার প্রচলিত রুচি ইংরেজি রুচির বিধানমতে বিচার করিলে ইহাতে নিল্লজ ব্যাপার কিছুই পাওয়া যাইবে না । বলিয়াছি, আমি ও কামিনী দুই জনে একবার একবার উকি মারিলাম। দেখি, পাড়ার যমুনাঠাকুরাণী সভাপত্নী হইয়া জম্‌কাইয়া বসিয়া আছেন, তাহার বয়স পয়তাল্লিশ হইয়াছে ; রঙট মিঠেরকম কালো, চোখ দুইটা ছোট ছোট, কিন্তু একটু ঢুলু ঢুলু, ঠোঁট দুখান। পুরু, কিন্তু রসে ভরা। বস্ত্ৰালঙ্কারের বাহার, পায়ে আলুতার বাহার, কালোতে রাঙ্গা, যেন যমুনাতেই জবা, মাথায় ছেড়া চুলের বাহার ৭ শরীরের ব্যাস পরিধি অসাধারণ