পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ইন্দির وجاك দেখিয়া আমার স্বামী তাহাকে নদীরূপা মহিষী বলিয়া ব্যঙ্গ করিতেছেন। মথুরাবাসীরা যমুনা নদীকে কৃষ্ণের নদীরূপ মহিষী বলিয়া থাকে, সেই কথা লক্ষ্য করিয়া উ-বাবু এই রসিকতা করিলেন । এখন আমার যমুনা দিদি কখনও মথুরায় যান নাই, এত খবরও জানেন না এবং মহিষী শব্দের অর্থটা জানেন না । তিনি মহিষী অর্থে কেবল মাদি মহিষই বুঝিয়াছিলেন এবং সেই জন্তুর সহিত আপনার শরীরের সাদৃশু লক্ষ্য করিয়া রাগে গর গর করিতে ছিলেন । প্রতিশোধাৰ্থ তিনি আমার স্বামীর সম্মুখে আমাকে প্রকারাস্তরে “গাই” বলিলেন, এমন সময়ে আমি দ্বার হইতে মুখ বাড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “ঘমুন দিদি ! কি গা ?” যমুনা দিদি বলিলেন, “একটা গাই ভাই।” আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “গাই কেন গা ?” কামিনী আমার পাশ হইতে বলিল, “ডেকে ডেকে ষমুন দিদির গল কাঠ হইয়া গিয়াছে। একবার পিওবে ” হাসির চোটে সভাপত্নী মহাশয়া নিবিয়া গেলেন, কামিনীর উপর গরম হইয়া বলিলেন, “এক রক্তি মেয়ে, তুই সকল ছড়িতে কাঠি দিস কেন লো কামিনি ?" কামিনী বলিল, “আর ত কেউ তোমার ভুসিকলাই সিদ্ধ করিতে জানে না ।" এই বলিয়া কামিনী পলাইল ; আমিও পলাইলাম। আবার একবার উকি মারিলাম, দেখি, পাড়ার পিয়ারী ঠানদিদি, জাতিতে বৈদ্য—বয়স পঞ্চমষ্টি বৎসর । তার মধ্যে পঞ্চবিংশ বৎসর বৈধবে। কাটিয়াছে—তিনি সৰ্ব্বাঙ্গে অলঙ্কার পরিয়া রাধিক সাজিয়া আসিয়াছেন । আমার স্বামীকে লক্ষ্য করিয়া “ক্লষ্ণ কৈ, কৃষ্ণ কৈ ?” বলিয়। সেই কামিনীকুঞ্জবন পরিভ্রমণ করিতেছেন । আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি খোজ ঠানদিদি ?” তিনি বলিলেন, “আমি কৃষ্ণকে খুজি ।” কামিনী বলিল, “গোয়ালাবাড়ী কায়েতের বাড়ী ।” রসিকতাপ্রবীণা বলিল, “কায়েতের বাড়ীই আমার কৃষ্ণ মিলিবে ।” কামিনী বলিল, “ঠানূদিদি, সকল জাতেই জাত দিয়াছ না কি ?” এখন পিয়ারী ঠাকুরাণীর এককালে তেলী অপবাদ ছিল । এই কথায় তিনি তেলে-বেগুনে জলিয়া উঠিয়া কামিনীকে ব্যঙ্গচ্ছলে গালি পাড়িতে ষাও—এ আরম্ভ করিলেন । আমি তাকে থামাইবার জন্ত, যমুনা দিদিকে দেখাইয়া বলিলাম, “রাগ কর কেন ? তোমার কৃষ্ণ ঐ যমুনায় ঝাপ দিয়াছেন। এসো— তোমায় আমায় পুলিনে দাড়াইয়া একটু কাদি ।” যমুনাঠাকুরাণী “মহিষী” শব্দের অর্থবোধে যেমন পণ্ডিত, “পুলিন" শব্দের অর্থবোধেও সেইরূপ । আমি বুঝি কোন পুলিনবিহারীর কথার ইঙ্গিত করিয়া তাহার অকলঙ্কিত সতী-সতীত্বের [ অকলঙ্কিত র্তাহার রূপের প্রভাবে ] প্রেতি কোন প্রকার ইঙ্গিত করিয়াছি । তিনি সক্রোধে বলিলেন, “এর ভিতর পুলিন কে লো ?” কাজেই আমারও একটু রঙ্গ চড়াইতে ইচ্ছা হইল। আমি বলিলাম, “যার গায়ে পড়িয়া যমুন রাত্রিদিন তরঙ্গভঙ্গ করে, বৃন্দাবনে তাকে পুলিন বলে ।” আবার তরঙ্গভঙ্গে সৰ্ব্বনাশ করিল,—ষমুনাদিদি উ কিছু বুঝিল না, রাগিয়া বলিল, “তোর তরঙ্গফরঙ্গকেও চিনি নে, তোর পুলিনকেও চিনি নে । তুই বুঝি ডাকাইতের কাছে এত রঙ্গরসের নাম শিখে এসেছিস্ !” মজলিসের ভিতর রঙ্গময়ী বলিয়া আমার এক জন সমবয়স্ক ছিল । সে বলিল, “অত আক্ষেপ কেন যমুনা দিদি ! পুলিন বলে নদীর ধারের চড়াকে । তোমার দুধারে কি চড় আছে ?” চঞ্চল নামে যমুনা দিদির ভাইজ, ঘোমটা দিয়া পিছনে বসিয়াছিল, সে ঘোমটার ভিতর মূহুমধুর স্বরে বলিল “চড়া থাকিলেও বাচিতাম। একটু ফরস দেখিতে পাইতাম । এখন কেবল কালো জলের কালিন্দী কল-কল করিতেছে ।" কামিনী বলিল, “আমার যমুনা দিদিকে কেন তোর অমন ক'রে চড়ার মাঝখানে ফেলে দিতেছিস ?” চঞ্চল বলিল “বালাই ! ষাট ! ঠাকুরবিকে চড়ার মাঝখানে ফেলে দিব কেন ? ওঁর ভাইয়ের পারে ধরে বলুব,যেন ঠাকুরবিকে মেঠে শ্মশানে দেন।” রঙ্গমল্পী বলিল, “টোতে তফাত কি বেী ?” চঞ্চল বলিল, “শ্বশানে শিয়াল-কুকুরের উপকার ; —চড়ায় গোরু-মহিষ চরে—তাদের কি উপকার ?” মহিষ কথাটা বলিবার সময়ে, বে। একবার ঘোস্ট তুলিল, ননদের উপর সহাস্ত কটাক্ষ করিল। যমুনা বলিল, “নে, আর একশবার সেই কথা ভাল লাগে না । যাদের মোষ ভাল লাগে, তারাই একশবার মোষ মোষ করুক গে ।” পিয়ারী ঠানদিদি কথাটায় বড় কান দেন নাই । তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “মোষের কথা কি গা ?”