পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছুর্গেশনন্দিনী তেল চাই, নহিলে জ্বলে না ; গৃহকার্ষ্যে চলে ; নিয়ে ঘর কর, ভাত রান্ধ, বিছানা পাড়, সব চলিবে ; কিন্তু স্পর্শ করিলে পুড়িয়৷ মরিতে হয়। তিলোত্তমাও রূপে আলো করিতেন—সে বালেন্দুজ্যোতির ন্যায় ; সুবিমল সুমধুর, সুশীতল ; কিন্তু তাহাতে গৃহকাৰ্য্য হয় না ; তত প্রখর নয়, এবং দূরনিঃস্থত । আয়েষাও রূপে আলো করিতেন, কিন্তু সে পূৰ্ব্বাহিক স্বৰ্য্যরশ্মির ন্যায় ; প্রদীপ্ত, প্রভাময়, অথচ যাহাতে পড়ে, তাহাই হাসিতে থাকে । যেমন উদ্যানমধ্যে পদ্মফুল, এ আখ্যায়িকামধ্যে তেমনি আয়েষা; এক্সন্ত তাহার অবয়ব পাঠক মহাশয়ের ধ্যান-প্রাপ্য করিতে চাহি । যদি চিত্রকর হইতাম, যদি এইখানে তুলি ধরিতে পারিতাম, যদি সে বর্ণ ফলাইতে পারিতাম ; না চম্পক, না রক্ত, না শ্বেতপদ্মকোরক, অথচ তিনই মিশিত, এমভ বর্ণ ফলাইতে পারিতাম : যদি সে কপাল তেমনি নিটোল করিয়া আণকিতে পারিতাম, নিটোল অথচ বিস্তীর্ণ, মন্মথের রঙ্গভূমি-স্বরূপ করিয়৷ লিখিতে পারিতাম : তাহার উপর তেমনই সুবঙ্কিম কেশের সীমারেখা দিতে পারিতাম : সে রেখা তেমনই পরিষ্কার, তেমনই কপালের গোলাকৃতির অনুগামিনী করিয়া আকর্ণ টানিতে পারিতাম ; কর্ণের উপরে সে রেখা তেমনই করিয়া ঘুরাইয়া দিতে পারিতাম : যদি তেমনই কালে রেশমের মত কেশগুলি লিখিতে পারিতাম, কেশমধ্যে তেমনই করিয়া কপাল হইতে সীতি কাটিয় দিতে পারিতাম—তেমনই পরিষ্কার, তেমনই সূক্ষ্ম ; যদি তেমনই করিয়া কেশ রঞ্জিত করিয়া দিতে পারিতাম ; যদি তেমনই করিয়া লোল কবরী বাধিয়া দিতে পারিতাম ; যদি সে অতি নিবিড় ক্রযুগ অ কিয়া দেখাইতে পারিতাম ; প্রথমে যথায় দুটি ভ্রা পরস্পর ংযোগাশয়ী হইয়াও মিলিত হয় নাই, তথা হইতে যেখানে যেমন বদ্ধিতায়তন হইয়। মধ্যস্থলে না আসিতে আসিতেই ষেরূপ স্থূলরেখ হইয়াছিল, পরে আবার যেমন ক্রমে ক্রমে সূক্ষ্মাকারে কেশবিন্যাস-রেখার •নিকটে গিয়া স্বচ্যগ্রবৎ সমাপ্ত হইয়াছিল, তাহ যদি দেখাইতে পারিতাম ; যদি সেই বিদ্যু্যদগ্নিপূর্ণ মেঘবৎ চঞ্চল, কোমল, চক্ষু:পল্লব লিখিতে পারিতাম ; যদি সে নয়নযুগলের বিস্তৃত আয়তন লিখিতে পারিতাম ; তাহার উপরিপল্লব ও অধঃপল্লবের সুন্দরী বঙ্কভঙ্গী, সে চক্ষুর নীলালক্তক-প্রভা, তাহার ভ্রমরকৃষ্ণ স্থল তারা লিখিতে পারিতাম ; যদি সে গৰ্ব্ববিশ্বফারিত রঞ্জ-সমেত মুনাসা ; সে রসময় ওষ্ঠাধর ; সে কবরী পৃষ্ট প্রস্তরশ্বেত গ্রীবা ; সে কর্ণাভরণম্পর্শপ্রার্থী পীবরাংস ; সে శ్రీ) স্থল, কোমল, রত্নালঙ্কার-খচিত বাহু ; ষে অঙ্গুলিতে রত্নাঙ্গুরীয় হীনভাস হইয়াছে, সে অঙ্গুলি ; সে পদ্মারক্ত, কোমল করপল্লব ; সে মুক্তাহার-প্রভানিন্দী পীবরোল্পত বক্ষঃ ; সে ঈষদীর্ঘ বপুর মনোমোহন ভঙ্গী ;–যদি সকলই লিখিতে পারিতাম ; তথাপি তুলি স্পর্শ করিতাম না। আয়েষার সৌন্দৰ্য্যসার, সে সমুদ্রের কৌস্তুভরত্ন, তাহার ধীর কটাক্ষ । সন্ধ্যাসমীরণকম্পিত নীলোৎপলতুল্য ধীরমধুর কটাক্ষ ! কি প্রকারে লিখিব ? রাজপুত্র আয়েষার প্রতি অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন । র্তাহার তিলোত্তমাকে মনে পড়িল । স্মৃতিমাত্র হৃদয় যেন বিদীর্ণ ইয়া গেল, শিরাসমূহমধ্যে রক্তস্রোতঃ প্রবল বেগে প্রধাবিত হইল, গভীর ক্ষত হইতে পুনৰ্ব্বার রক্তপ্রবাহ ছুটিল, রাজপুত্র পুনৰ্ব্বার বিচেতন হইয়া চক্ষু মুদ্রিত করিলেন । খটারূঢ়া সুন্দরী তৎক্ষণাৎ ত্রস্তে গাত্ৰোখান করিলেন । যে ব্যক্তি গালিচায় বসিয়া পুস্তক পাঠ করিতেছিল, সে মধ্যে মধ্যে পুস্তক হইতে চক্ষু তুলিয়া সপ্রেম দৃষ্টিতে আয়েসাকে নিরীক্ষণ করিতেছিল ; এমন কি, যুবতী পালঙ্ক হইতে উঠিলে, তাহার যে কর্ণাভরণ দুলিতে লাগিল, পাঠান তাহাই অনেকক্ষণ অপরিতৃপ্ত লোচনে দেখিতে লাগিল । আয়েষ। গাত্রোথান করিয়া ধীরে ধীরে পাঠানের নিকট গমন পূর্বক তাহার কাণে কাণে কহিলেন, “ওসমাম, শীঘ্র হকিমের নিকট লোক পাঠাও ” দুর্গজেত ওসমান গাই গালিচায় বসিয়াছিলেন। আয়েষার কথা শুনিয়া তিনি উঠিয়া গেলেন । আয়েষা, একটা রূপার সেপায়ার উপরে যে পাত্র ছিল তাঙ্গ হইতে একটু জলবৎ দ্রব্য লইয়া পুনমূৰ্ছিগত রাজপুত্রের কপালে, মুখে সিঞ্চন করিতে লাগিলেন । ওসমান গঁ। অচিরাং হকিম লইয়া প্রত্যাগমন করিলেন । হকিম অনেক যত্নে রক্তস্রাব নিবারণ করিলেন এবং নানাবিধ ঔষধ আয়েষার নিকট দিয়া মৃদু মৃদু স্বরে সেবনের ব্যবস্থা উপদেশ করিলেন । আয়েষ কাণে কাণে জিজ্ঞাসা করিলেন,—“কেমন অবস্থা দেখিতেছেন ?" হকিম কহিলেন;–“জর অতি ভয়ঙ্কর।” হকিম যখন বিদায় লইয়া প্রতিগমন করেন, তখন ওসমান তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গিয়া দ্বারদেশে তাহাকে মৃত্নস্বরে কহিলেন;–“রক্ষা পাইবে ?” হকিম কহিলেন—“আকার নহে, পুনৰ্ব্বার যাতন৷ হইলে আমাকে ডাকিবেন ।” «omsmæssimismasso