পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 o দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ কুসুমের মধ্যে পাষাণ সেই দিবস অনেক রাত্রি পর্যন্ত আয়েষা ও ওসমান জগতসিংহের নিকট বসিয়া রছিলেন । জগতসিংহের কখন চেতনা হইতেছে, কখন মূৰ্ছা হইতেছে, হকিম অনেকবার আসিয়| দেখিয় গেলেন । আয়েয অবিশ্রাস্ত হইয়া কুমারের শুশ্রুষা করিতে লাগিলেন । যখন দ্বিতীয় প্রহর, তখন এক জন পরিচারিক আসিয়া আয়েষাকে কহিল যে, বেগম তাহাকে স্মরণ করিয়াছেন । “যাইতেছি বলিয়া আয়েম। গাত্ৰোত্থান করিলেন । ওসমানও গাত্রোথান করিলেন । আয়েম জিজ্ঞাস। করিলেন, —“তুমিও উঠিলে ?” ওসমান কহিলেন --“রাত্রি তোমাকে রাখিয়া আসি ।" আয়েন দাসদাসীদিগকে সতর্ক থাকিতে আদেশ করিয়া মাতৃগৃহ অভিমুখে চলিলেন । পথে ওসমান জিজ্ঞাস করিলেন, -“তুমি কি আঞ্জ বগমের নিকটে থাকিবে ?" আরেষা কহিলেন -“ন।, আমি আবার রাজ পুত্রের নিকট প্রত্যাগমন করিব।” ওসমান কহিলেন –“আয়েষ ! তোমার গুণের সীমা দিতে পারি না ; তুমি এই পরম শক্রকে ধে ধত্ব করিয়া শুশ্ৰুষা করিতেছ, ভগিনী ভ্রাতার জন্য এমন করে না। তুমি উহার প্রাণদান করিতেছ।” আয়েষ ভুবনমোহন মুখে একটু হাসি হাসিয়। কহিলেন, “ওসমান ! আমি ত স্বভাবতঃ রমণী ; পীড়িতের সেব। আমার পরম ধৰ্ম্ম ; না করিলে দোষ, করিলে প্রশংসা নাই ; কিন্তু তোমার কি ? ষে তোমার পরম বৈরী --রণক্ষেত্রে তোমার দর্পহারী প্রতিযোগী,-স্বহস্তে যাহার এ দশ ঘটাইয়াছ, তুমি ষে অনুদিন নিজে ব্যস্ত থাকিয় তাহার সেবা করাইতেছ, তাহার আরোগ্যসাধন করাইভেচ্ছ, ইহাতে তুমিই যথার্থ প্রশংসাভাজন ।” ওসমান কিঞ্চিৎ অপ্রতিভের স্যায় হইয়া কহিলেন, —“তুমি আয়েষ, আপনার সুন্দর স্বভাবের মত সকলকে দেখ । আমার অভিপ্রায় তত ভাল নহে। তুমি দেখিতেছ না, জগৎসিংহ প্রাণ পাইলে আমাদিগের কত লাভ ? রাজপুত্রের এক্ষণে মৃত্যু হইলে আমাদিগের কি হইবে ? রণক্ষেত্রে মানসিংহ, জগৎ সিংহের নূ্যন নহে, এক জন যোদ্ধার পরিবর্তে আর হইয়াছে, চিল, বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী এক জন যোদ্ধা আসিবে । কিন্তু যদি জগতসিংহ জীবিত থাকিয়া আমাদিগের হস্তে কারারুদ্ধ থাকে, তবে মানসিংহকে হাতে পাইলাম ; সে প্রিয়পুত্রের মুক্তির জন্য অবশ্য আমাদিগের মঙ্গলজনক সন্ধি করিবে ; আকবরও এতাদৃশ দক্ষ সেনাপতিকে পুনঃপ্রাপ্ত হুইবার জন্য অবশ্য সন্ধির পক্ষে মনোযোগী হইতে পরিবে ; আর যদি জগতসিংহকে আমাদিগের সদ্ব্যবহার দ্বারা বাধ্য করিতে পারি, তবে সেও আমাদিগের মনোমত সদ্ধিবন্ধন পক্ষে অনুরোধ কি যত্ন করিতে পারে ; তাহার যত্ন নিতান্ত নিষ্ফল হইবে না । নিতান্ত কিছু ফল না দর্শে, তবে জগতসিংহের স্বাধীন তার মূল্যস্বরূপ মানসিংহের নিকট বিস্তর ধনও পাইতে পারিব । সম্মুখসংগ্রামে এক দিন জরী হওয়ার অপেক্ষাও জগতসিংহের জীবনে আমাদিগের উপকার ।" ওসমান এই সকল আলোচন কবিয় রাজপুত্রের পুনৰ্জ্জীবনে যত্নবান্‌ গুইয়াছিলেন, সন্দেহ নাই ; কিন্তু আর কিছুও ছিল। কাহার ও কাঙ্গরও অভ্যাস আছে যে, পাছে লোকে দয়ালুচিত্ত বলে এই লজ্জার আশস্কায় কাঠিন্য প্রকাশ করেন এবং দানশীলতা নারীস্বভাল সিদ্ধ বলিয়া উপহাস করিতে করিতে পরোপকার করেন । লোকে জিজ্ঞাসিলে বলেন, ইহাতে আমার বড় প্রয়োজন আছে । আরেসা বিলক্ষণ জানিতেন, ওসমান ভাঙ্গরই এক জন । ভাসিতে ভাসিতে বলিলেন, “ওসমান ! সকলেই যেন তোমার মত স্বার্থ পরতায় দূরদর্শী হয় । তাঙ্গ| হুইলে আর ধৰ্ম্মে কাজ নাই ।” ওসমান কিঞ্চিৎকাল ইতস্ততঃ করির মুঢ়তরস্বরে কহিলেন, “আমি ষে পরম স্বার্থপর, তাহার আর এক প্রমাণ দিতেছি ।" আয়েম নিজ সবিদ্যং মেঘতুল চক্ষুঃ ওসমানের বদনের প্রতি স্থির করিলেন । ওসমান কহিলেন, “আমি আশ{লত ধরিয়া আছি, আর কত কাল তাহার তলে জলসিঞ্চন করিব ?” আয়েষার মুখশ্ৰী গম্ভীর হইল । ওসমান এ ভাবান্তরেও নূতন সৌন্দর্য্য দেখিতে লাগিলেন। আয়েষা কহিলেন, “ওসমান ! ভাই বহিন বলিয়া তোমার সঙ্গে বসি দাড়াই। বাড়াবাড়ি করিলে, তোমার সাক্ষাতে বাহির হইব না।” ওসমানের হর্ষোৎফুল্ল মুখ মলিন হইয়া গেল । কহিলেন,-“ঐ কথা চিরকাল! স্বষ্টিকৰ্ত্তা ! এ কুমুমের দেহমধ্যে তুমি কি পাষাণের হৃদয় গড়িয়া রাখিয়াছ ?”