পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(to কে রুগ্ন শয্যার না শয়ন করিয়াছেন ? যদি কাহারও রুগ্ন-শষ্যার শিল্পরে বসিয়া মনোমোহিনী রমণী ব্যঞ্জন করিয়া থাকে, তবে সেই জানে রোগেও সুখ । পাঠক ! তুমি জগতসিংহের অবস্থ। প্রতক্ষীভূত করিতে চাহ ? তবে মনে মনে সেই শয্যায় শয়ন কর, শরীরে ব্যাধিযন্ত্রণ অষ্ট্রভূত কর ; স্মরণ কর যে, শক্রমধ্যে বন্দী হইরা আছ । তার পর সেই সুবাসিত সুসজ্জিত, সুস্নিগ্ধ শয়নকক্ষ মনে কর । শষ্যায় শয়ন করিয়৷ তুমি দ্বারপানে চাহিয়া আছ : অকস্মাৎ তোমার মুখ প্রফুল্ল হইয়। উঠিল : এই শত্রপুরীমধ্যে ৭ে তোমাকে সহোদরীর ন্যায় যত্ন করে, সেই আসিতেছে । সে আবার রমণী, বুবতী : পূর্ণবিকসিত পদ্ম অমনি শয়ন করিয়া একদৃষ্টি চাহিয়৷ আছে, দেখ কি মূৰ্ত্তি ! ঈষৎ - ঈযৎমাত্র দীর্ঘ আয়তন, তদুপযুক্ত গঠন, মহামহিম দেবীপ্রতিমাস্বরূপ ! প্রকৃতি-নিয়মিত রাষ্ট্ৰীস্বরূপ ! দেখ কি ললিত পাদবিক্ষেপ ! গজেন্দ্রগমন শুনিয়াছ ? সে কি ? মরাল গমন বল ? ঐ পাদবিক্ষেপ দখ : সুরের লন, বাদ্যে হয় ; ঐ পাদবিক্ষেপের লম্ব, তোমার হৃদয়মধ্যে হইতেছে । হস্তে ঐ কুসুমদাম দেখ, হস্তপ্রভায় কুসুম মলিন হইয়াছে দেখিয়াছ ? কণ্ঠের প্রভায় স্বর্ণহার দাপ্তিমান হুইয়াছে দেখিয়াছ ? তোমার চক্ষের পলক পড়ে না কেন ? দেখিয়াছ, কি সুন্দর গ্রীবাভঙ্গী ? দেখিয়াছ, প্রস্তরধবল গ্রীবার উপর কেমন নিবিড় কুঞ্চিত কেশগুচ্ছ পড়িয়াছে ? দেখিয়াছ, তৎপাশ্বে কেমন কৰ্ণ ভূল চলিতেছে ? মস্তকের ঈষৎ---ঈষৎমাত্র বঙ্কিম ভঙ্গা দেখিয়াছ ? ও কেবল ঈষৎ দৈর্ঘ্যহেতু । তাত একদৃষ্টি চাহিতেছ কেন ? আপ্লেব। কি মনে করিবে ? যত দিন জগতসিংহের রোগের শুশ্ৰণ। আবখ্যক হইল, তত দিন পর্যন্ত আয়েয। প্রত্যঙ্গ এইরূপ অনবরত তাহাতে নিযুক্ত রহিলেন । ক্রমে যেমন রাজপুত্রের রোগের উপশম হইতে লাগিল, তেমনি আয়েষারও যাতায়াত কমিতে লাগিল । যখন রাজপুলের রোগ নিঃশেষ হইল, তখন তামেমার জগতসিংহের নিকট যাতায়াত প্রায় একেবারে শেন হইল ; কদাচিৎ দুই একবার আসিতেন । যেমন শীতার্ত ব্যক্তির অঙ্গ হইতে ক্রমে ক্রমে বেলাধিকে রৌদ্র সরিয়া যায়, জায়েষ সেইরূপ ক্রমে ক্রমে জগৎসিংহ হইতে আরোগ্যকালে সরিয়া যইতে লাগিলেন । একদিন গৃহমধ্যে অপরাহ্লে জগৎসিংহ গবাক্ষে দাড়াইয়া দুর্গের বাহিরে দৃষ্টিপাত করিতেছেন ; কত বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী লোক অবাধে নিজ নিজ ঈপ্সিত বা প্রয়োজনীয় স্থানে যাতায়াত করিতেছে, রাজপুত্র দুঃখিত হইয়া তাহদিগের অবস্থার সহিত আত্মাবস্থা তুলনা করিতে ছিলেন । এক স্থানে কয়েক জন লোক মণ্ডলীকৃত হইয়। কোন ব্যক্তি বা বস্তু বেষ্টন পূৰ্ব্বক দাড়াইয়াছিল । রাজপুত্রের তৎপ্রতি দৃষ্টিপাত হইল। বুঝিতে পারিলেন যে, লোকগুলি কোন আমোদে নিযুক্ত আছে, মন দিয়া কিছু শুনিতেছে। মধ্যস্থ ব্যক্তি কে বা বস্তুটি কি, তাহ কুমার দেখিতে পাইতেছিলেন না । কিছু কৌতুহল জন্মিল। কিয়ৎক্ষণ পরে, কয়েক জন শ্ৰোত চলিয় গেলে, কুমারের কৌতুহলনিবারণ হইল ; দেখিতে পাইলেন মণ্ডলীমধ্যে এক ব্যক্তি একথান। পুতির ন্যায় কয়েকখণ্ড পত্র লইয়। তাহ হইতে কি পড়িয় শুনাইতেছে । আবৃত্তিকৰ্ত্তার আকার দেখিয়৷ রাজকুমারের কিছু কৌতুক জন্মিল । তাহাকে মনুষ্য বলিলেও বলা যায়, বজ্রাঘাতে পত্রভ্রষ্ট মধ্যমাকার তালগাছ বলিলেও বলা যায় । প্রায় সেইরূপ দীর্ঘ, প্রন্থেও তদ্রুপ ; তবে তালগাছে কখনও তাদৃশ গুরু নাসিকাভার দ্যস্ত হয় না । আকারেঙ্গিতে উভয়ই সমাম । পুতি পড়িতে পড়িতে পাঠক যে হাতনাড়া, মাথানাড়া দিতেছিলেন, রাজকুমার তাহ অবাক হইয়। দেখিতে লাগিলেন । ইতিমপে ওসমান গৃহমধ্যে ত্যাসিয়। উপস্তিত হইলেন । পরস্পর অভিবাদনের পর ওসমান কহিলেন, “আপনি গবাক্ষে অন্যমনস্ক হইয়া কি দেখিতেছিলেন ?" জগতসিংহ কহিলেল,-“সরল কাষ্ঠবিশেষ । দেখিলে দেখিতে পাইবেন ।" ওসমান দেখিয়৷ কন্সিলন, “রাজপুত্র, উহাকে কখন দেখেন লাই ?” রাজপুত্ৰ কছিলেন, “ন। " ওসমান কহিলেন, “ও আপনাদিগের ব্রাহ্মণ । কথাবাৰ্ত্তায় বড় সরস : ও ব্যক্তিকে গড়মান্দারণে দেখিয়াছিলাম।" রাজকুমার অন্তঃকরণে চিন্তিত হইলেন । গড়মানদারণে ছিল ? তবে এ ব্যক্তি কি তিলোত্তমার কোন সংবাদ বলিতে পারিবে না ? এই চিন্তায় ব্যাকুল হইয়। কহিলেন, “মহাশয়, উহার নাম কি ?” ওসমান চিন্তা করিয়া কহিলেন, “উহার নামটি কিছু কঠিন, হঠাৎ স্মরণ হয় না। গণপত ? না ; --~গণপত—গজপত না : গজপত কি ? “গজপত? গজপত এদেশীয় নাম নহে, অথচ দেখিতেছি, ও ব্যক্তি বাঙ্গালী |"