করিতেছে ; বায়ু আর গোলাবের গন্ধের ভার বহন করিতে পারে না ; অগণিত দাসীবর্গ কেহ বা হৈমকাৰ্যখচিত বসন, কেহ বা ইচ্ছামত নীল, লোহিত, খামল, পাটলাদি বর্ণের চীনবাস পরিধান করিয়া অঙ্গের স্বর্ণালঙ্কার প্রদীপের আলোকে উজ্জল করিয়া ভ্রমণ করিতেছে। তাহারা যাহাদিগের দাসী, সে জুনারীরা কক্ষে কক্ষে বসিয়া মহাযত্নে বেশ-বিন্যাস করিতেছিলেন । আজ নবাব প্রমোদমন্দিরে আসিয়া সকলকেই লইয়া প্রমোদ করিবেন ; মৃত্যগীত হইবে । যাহার যাহা অভীষ্ট, সে তাহা সিদ্ধ করিয়া লইবে ; কেহ আজ ভ্রাতার চাকরী করিয়া দিবেন। আশায় মাথায় চিরুণী জোরে দিতেছিলেন । অপরা, দাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া লইবেন ভাবিয়া অলকগুচ্ছ বক্ষঃ পৰ্য্যস্ত নামাইয়া দিলেন । কাহারও নবপ্রস্ত পুত্রের দানস্বরূপ কিছু সম্পত্তি হস্তগত করা অভিলাষ, এ জন্য গণ্ডে রক্তিম বিকাশ করিবার অভিপ্রায়ে ঘর্ষণ করিতে করিতে রুধির বাহির করিলেন । কেহ ব। নবাবের কোন প্রেয়সী ললনার নবপ্রাপ্ত রত্নালঙ্কারের অনুরূপ অলঙ্কার কামনায় চক্ষুর নীচে আকর্ণ কজ্জল লেপন করিলেন । কোন চণ্ডীকে বসন পরীক্টতে দাসী পেশোয়াজ মাড়াইম ফেলিল, চণ্ডী তাঙ্গার গালে একট। চাপড় মারিলেন । কোন প্ৰগল্ভার বরোমাঙ্গত্ম্যে কেশরাশির ভার ক্রমে শিথিলমূল হইয়া আসিতেছিল, কেশববিন্যাসকালে দাসী চিরুণী দিতে কতকটি চুল চিরুণীর সঙ্গে উঠিয়া আসিল ; দেখিয়া কেশাধিক। রিণী দরবিগলিত চক্ষুতে উচ্চরবে কাদিতে লাগিলেন । কুসুমবনে স্থলপদ্মবৎ, বিহঙ্গকুলে কলাপিবৎ এক সুন্দরী বেশবিদ্যাস সমাপন করিয়া কক্ষে কক্ষে ভ্রমণ করিতেছিলেন । অদ্য কাহারও কোথাও যাইতে বাধ৷ ছিল না। যেখানকার যা সৌন্দর্য্য, বিধাতা সে সুন্দরীকে তাহ দিয়াছেন ; যে স্থানের যে অলঙ্কার, কতলু খাঁ তাহ দিয়াছেন ; তথাপি সে রমণীর মুখমধ্যে কিছুমাত্র সৌন্দৰ্য-গৰ্ব্ব বা অলঙ্কারগৰ্ব্ব চিহ্ন ছিল না । আমোদ, হাসি কিছুই ছিল না। মুখকাস্তি গম্ভীর, স্থির ; চক্ষুতে কঠোর জ্বালা । বিমলা এইরূপ পুরীমধ্যে স্থানে স্থানে ভ্রমণ করিয়া এক সুসজ্জীভূত গৃহে প্রবেশ করিলেন, প্রবেশানস্তর দ্বার অর্গলবদ্ধ করিলেন। এউৎসবের দিনেও সে কক্ষমধ্যে একটিমাত্র ক্ষীণালোক জলিতেছিল। কক্ষের এক প্রান্তভাগে একখানি পালঙ্ক ছিল । সেই পালঙ্কে আপাদমস্তক শষ্যোত্তরচ্ছদে আবৃত হইয়া কেহ শয়ন করিয়াছিল। বিমলা পালঙ্কের পাশ্বে দাড়াইয়া মৃদুস্বরে কহিলেন, “আমি আসিয়াছি !" “ိုင္ဆိုႏွစ္တ ఉ শয়ান ব্যক্তি চমকিতের ন্যায় মুখের আবরণ দূরঃ করিল। বিমলাকে চিনিতে পারিয়া, শয্যোত্তরচ্ছদ, ত্যাগ করিয়া, গাত্রোথান করিয়া বসিল, কোন উত্তর } করিল না । বিমল পুনরপি কহিলেন, “তিলোত্তম । আমি: আসিয়াছি ” তিলোত্তম তথাপি কোন উত্তর করিলেন না । , স্থিরদৃষ্টিতে বিমলার মুখপ্রতি চাহিয়৷ রছিলেন । । তিলোত্তম। আর রীড়া বিবশ বালিকা নহে i; তদণ্ডে ষ্টাঙ্গাকে সেই ক্ষীণালোকে দেখিলে বোধ হইত। সে, দশ বৎসর পরিমাণ বয়োবৃদ্ধি হইয়াছে। দেহ অত্যন্ত শীর্ণ, মুখ মলিন । পরিধান একখানি সঙ্কীর্ণয়তন বাস । অবিন্যস্ত কেশভারে ধূলিরাশি জড়িত । হইয়া রহিয়াছে । অঙ্গে অলঙ্কারের লেশ নাই ; কেবল পূৰ্ব্বে যে অলঙ্কার পরিধান করিতেন, তাহার চিহ্ন রহিয়াছে মাত্র । - বিমল পুনরুপি কহিলেন,—“আমি আসিব বলিয়াছিলাম—আসিয়াছি । কথা কহিতেছ না কেন ?” তিলোত্তম কহিলেন, “যে কথা ছিল, তাহা সকল কহিয়াছি, আর কি কহিব ?" - বিমল| তিলোত্তমার স্বরে বুঝিতে পারিলেন যে,— তিলোত্তম রোদন করিতেছিলেন ; মস্তকে হস্ত দিয়া ঠাঙ্গার মুখ তুলিয়া দেখিলেন, চক্ষুর জলে মুখ প্লাবিত রহিয়াছে ; অঞ্চল স্পর্শ করিয়া দেখিলেন, অঞ্চল সম্পূর্ণ আদ্র। যে উপাধীনে মাথা রাখিয়া তিলোত্তম শয়ন করিয়াছিলেন, তাহাতে হাত দিয়া দেখিলেন, তাঙ্গাও প্লাবিত । বিমল কহিলেন, “এমন দিবানিশি, কাদিলে শরীর কন্ন দিন বহিবে ?” তিলোত্তম আগ্রহসহকারে কহিলেন, “বহিয়া কাজ কি ? এত দিন বহিল কেন, এই মনস্তাপ " | বিমলা নিরুত্তর রহিলেন । তিনিও রোদন করিতে: লাগিলেন । * কিয়ৎক্ষণ পরে বিমলা দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কহিলেন, “এখন আজিকার উপায় ?” তিলোত্তম অসন্তোষের সহিত বিমলার অলঙ্কার দির দিকে পুনৰ্ব্বার চক্ষুপাত করিয়া কহিলেন। “উপায়ের প্রয়োজন কি ” ** বিমলা কহিলেন, “বাছা, তাচ্ছল্য করিও না । আজও কি কতলু খাকে বিশেষ জান না ? আপনার; অবকাশ অভাবেও বটে, আমাদিগের শোকনিবারণার্থ অবকাশ দেওয়ার অভিলাষেও বটে, এ পর্ষ্যস্ত দুরাত্মা আমাদিগকে ক্ষমা করিয়াছে ; আজ পর্য্যত্ব
পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৬১
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।