পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

a8 “আমাকে স্মরণ করিয়াছেন কি জন্য ? রোদনই বা কেন ?” অভিরাম স্বামী কহিলেন, “যে কারণে রোদন করিতেছি, সেই কারণেই তোমাকে ডাকিয়াছি : তিলোত্তমার মৃত্যুকাল উপস্থিত ।” ধীরে ধীরে, মৃদু মৃদু, তিল তিল করিয়া যোদ্ধপতি সেইখানে ভূতলে বসিয় পড়িলেন ; তখন আদ্যেH পান্ত সকল কথা একে একে মনে পড়িতে লাগিল : একে একে অন্তঃকরণমপ্যে দারুণ তীক্ষু ছুরিকাঘাত হইতে লাগিল । দেলালয়ে প্রথম সন্দর্শন, শৈলেশ্বরসাক্ষাৎ প্রতিজ্ঞ, কক্ষমধ্যে প্রথম পরিচয়ে উভয়ের প্রেমোখিত অশ্রুজল, সেই কালরাত্রির ঘটন, তিলে। শুমার মূর্ছাবস্থার মুখ, যবনাগারে তিলোত্তমার পীড়ন, কারাগারমধ্যে নিজ নিৰ্দ্দয়ব্যবহার, পরে এক্ষণকার এই বনবাসে মৃত্যু, এই সকল একে একে রাজকুমারের হৃদয়ে আসিয়া ঝটিক প্রঘাতধত্ব লাগিতে লাগিল । পুৰ্ব্বহুতাশন শতগুণ প্রচণ্ড জালার সহিত জলিয়। উঠিল । রাজপুল্ল অনেকক্ষণ মৌন হুইয়। বসিয়। রঙ্গিলেন । অভিরাম স্বামী বলিতে লাগিলেন, “ষে দিন বিমল। যবনবধ করিয়া বৈধব্যের প্রতিশোধ করিয়াছিল, সেই দিন অবধি আমি কল্প দৌহিত্রী লষ্টয় সবনভয়ে নানা স্থানে অজ্ঞাতে ভ্রমণ করিতেছিলাম, সেই দিন অবধি তিলোত্তমার রোগের সঞ্চার । যে কারণে রোগের সঞ্চার, তাহা তুমি বিশেষ অবগত আছ " জগতসিংহের হৃদয়ে শেল বিধিল । “সে অবধি তাহাকে নান। স্থানে রাখিয়া নানামত চিকিৎসা করিয়াছি ; নিজে যৌবনাবধি চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছি ; অনেক রোগের চিকিৎসা করিয়াছি ; অন্যের অজ্ঞাত অনেক ঔষধ জানি : কিন্তু যে রোগ হৃদয়মধ্যে, চিকিৎসায় তার প্রতীকার নাই। এই স্থান অতি নির্জন বলিয়া ইহারই মধ্যে এক নিভৃত অংশে আজ পাচ সাত দিন বসতি করি তেছি । দৈবযোগে এখানে তুমি আসিয়াছ দেখিয়। তোমার অশ্ববলুগায় পত্র বাধিয়া দিয়াছিলাম। পূৰ্ব্ববধি অতিলাষ ছিল যে তিলোত্তমাকে রক্ষা করিতে না পরিলে, তোমার সহিত আর একবার সাক্ষাৎ করাইয়া অন্তিমকালে তাহার অস্তঃকরণকে তৃপ্ত করিব । সেই জন্যই তোমাকে আসিতে লিখিয়াছি । তখনও তিলোত্তমার আরোগ্যের ভরসা দূর হয় নাই ; কিন্তু বুঝিয়াছিলাম যে, দুই দিনমধ্যে কিছু উপশম না হইলে চরমকাল উপস্থিত হুইবে । এই জন্য দুই দিন পরে পত্র পড়িবার পরামর্শ দিয়াছিলাম। এক্ষণে ষে ভয় করিযুছিলাম, তাঁহাই ঘটিয়াছে । তিলোত্তমার জীবনের বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী আর কোন আশা নাই ; জীবন-দীপ নিৰ্ব্বাণোন্মুখ হইয়াছে ” এই বলিয়া অভিরাম স্বামী পুনৰ্ব্বার রোদন করিতে লাগিলেন । জগৎসিংহও রোদন করিতে" ছিলেন । স্বামী পুনশ্চ কহিলেন, “অকস্মাৎ তোমার তিলেহুমাসন্নিপানে যাওয়৷ হইবে ন| কি জানি, যদি এ অবস্থায় উল্লাসের তাধিক সহ্য ন হয় । আমি পূৰ্ব্বেই বলিয়া রাখিয়াছি যে, তোমাকে আসিতে সংবাদ দিয়াছি, তোমার আসার সম্ভাবনা আছে । এইক্ষণে আসার সংবাদ দিয়া আসি, পশ্চাৎ সাক্ষাৎ করিও ” এই বলিয়। পরমহংস যে দিকে ভগ্নাটালিকার অন্তঃপুর, সেই দিকে গমন করিলেন । কিয়ৎক্ষণ পরে প্রত্যাগমন করিয়। রাজপুলকে কহিলেন: °ਕੋਠੋਸ " রাজপুল পরমহংসের সঙ্গে অন্তঃপুরাভিমুখে গমন করিলেন । দেখিলেন, একটি কক্ষ অভগ্ন আছে, তন্মধ্যে জীর্ণ ভগ্ন পালঙ্ক, তদুপরি ব্যাধিক্ষীণ। অথচ অনতিবিলুপ্ত রূপরাশি তিলোত্তম। শয়ান রহিয়াছে ; এ সময়েও পূৰ্ব্বলাবণের মুহূলতর প্রভাপরিবেষ্টিত রহিয়াছে, -নিৰ্ব্বাণোন্মুখ প্রভাততারার ন্যায় মনোমোহিনী হইয়। রঙ্গিয়াছে : নিকটে একটি বিবব বসিয়া অঙ্গে হস্তমার্জন করিতেছে ; সে নিরাভরণা, মলিন, দীন বিমল । রাজকুমার তাহাকে প্রথমে চিনিতে পারিলেন ন! : কিসেক্ট বা চিনিবেন, যে স্থিরযৌবন ছিল সে এক্ষণে প্রাচীন হইয়াছে । যখন রাজপুত্ৰ আসিয়া তিলোত্তমার শয্যাপার্শ্বে দাড়াইলেন, তখন তিলোত্তম নয়ন মুদ্রিত করিয়াছিলেন । অভিরাম স্বামী - ডাকিয় কহিলেন, “তিলোত্তমে । রাজকুমার জগতসিংহ আসিয়াছেন।” তিলোত্তম নয়ন উন্মীলিত করিয়া জগৎসিংহের প্রতি চাহিলেন ; সে দৃষ্টি কোমল, কেবল স্নেহব্যঞ্জক, তিরস্করণাভিলাষের চিহ্নমাত্রবর্জিতা , তিলোত্তম চাহিবামাত্র দৃষ্টি বিনত করিলেন, দেখিতে দেখিতে লোচনে দর-দর ধারা বঙ্গিতে লাগিল। রাজকুমার আর থাকিতে পারিলেন না লজ্জ দুরে গেল ; তিলোত্তমার পদপ্রাস্তে বসিয়া নীরবে নয়নাসারে তাহার দেহলত সিক্ত করিলেন ।