পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ot 烈· একবিংশ পরিচ্ছেদ সফলে নিষ্ফল স্বপ্ন পিতৃহীন অনাথিনী রুগ্নশয্যায় ; জগতসিংহ তাহার শয্যাপাশ্বে । দিন যায়, রাত্রি যায়, আর বার দিন আসে ; আর বার দিন যায়, রাত্রি আসে । রাজপুতকুলগৌরব তাহার ভগ্ন পালঙ্কের পাশে বসিয়৷ শুশ্ৰুষা করিতেছেন । সেই দীন, শব্দহীন। বিধবার অবিরল কাৰ্য্যের সাহায্য করিতেছেন । আধিক্ষীণ৷ দুঃখিনী তাহার পানে চাহে কি না--তার শিশিরনিপীড়িত পদ্মমুখে পূৰ্ব্বকালের সে হাসি আসে কি না, তাহাই দেথিবীর আকাজক্ষায় তাহার মুখপানে চাহিয়া আছেন । কোথায় শিবির ? কোথায় সেন ?-–শিবির ভঙ্গ করিয়া সেন। পাটনায় চলিয়। গিয়াছে । কোথায় অনুচর সব ? দারুকেশ্বর তীরে প্রভুর আগমন প্রতীক্ষা করিতেছে। কোথায় প্রভু ? –প্রবলাতপ বিশোষিত সুকুমার কুসুমকলিকায় নযনবারিসেচনে পুনরুৎফুল্ল করিতেছেন । কুসুমকলিকা ক্রমে পুনরুৎফুল্ল শুষ্টতে লাগিল । এ সংসারে প্রধান ঐন্দ্রজালিক স্নেহ । ব্যাধিপ্রতিকারে প্রধান ঔষপ প্রণয় । লঙ্গিলে হৃদয়ব্যাধি কে উপশম করিতে পারে ? যেমন নিৰ্ব্বাণোন্মুখ দীপ বিন্দু বিন্দু তৈলসঞ্চারে ধীরে ধীরে আবার হাসিয় উঠে, যেমন নিদাঘশুষ্ক বল্লর আষাঢ়ের নববরিসিঞ্চনে ধীরে ধীরে পুনৰ্ব্বার বিকসিত হয়, জগতসিংহকে পাইয়। তিলোত্তম।-তদ্রুপ দিনে দিনে পুনৰ্জ্জীবন পাইতে লাগিলেন । ক্রমে সবল হইয়। পালঙ্কোপরি বসিতে পারিলেন। বিমলার অবর্তমানে দুজনে কাছে কাছে বসিয়া, অনেক দিনের মনের কথা সকল বলিতে পারিলেন । কত কথা বলিলেন, মানসক্লত কত অপরাধ ক্ষম। করিলেন কত অন্যায় ভরসা মনোমধ্যে উদয় হইয়। মনোমধ্যেই নিবৃত্ত হইয়াছিল, তাহা বলিলেন ; জাগ রণে কি নিদ্রায় কত মনোমোহন স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন, তাহা বলিলেন । রুগ্ন শয্যায় শয়নে, অচেতনে যে এক স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন, একদিন তাহা বলিলেন— যেন নব বসন্তের শোভাপরিপূর্ণ এক ক্ষুদ্র পৰ্ব্বতোপরি তিনি জগৎসিংহের সহিত পুষ্পক্রীড়া করিতেছিলেন ; শুপে স্তপে বসস্ত কুসুম চয়ন করিয়া মালা গাঁথিলেন, আপনি এক মালা কণ্ঠে পরিলেন, আর এক মালা জগৎসিংহের কণ্ঠে দিলেন ; se জগতসিংহের কটিস্থ আসিম্পর্শে মাল ছিড়িয়া গেল। : “আর তোমার কণ্ঠে মাল| দিব না, চরণে নিগড়: দিয়া বাধিব,” এই বলিয়া যেন কুসুমের নিগড় রচনা " করিলেন। নিগড় পরাইতে গেলেন, জগৎসিংহ : আমনি সরিয়া গেলেন, তিলোত্তম পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হইলেন ; জগৎসিংহ বেগে পৰ্ব্বত অবতরণ করিতে লাগিলেন : পথে এক ক্ষীণ। নিঝরিণী ছিল; জগতসিংহ লম্ফ দিয়। পার হইলেন ; তিলোত্তম, স্ত্রীলোক-লম্ফে পার হইতে পারিলেন না ; ষেখানে ; নিঝরিণী সঙ্কীণ হইয়াছে, সেইখানে পার হইৰেন, এই আশায় নিঝরিণীর ধারে ধারে ছুটিয়া পৰ্ব্বত অবতরণ করিতে লাগিলেন । নিঝরিণী সঙ্কীর্ণ হওয়া দূরে থাকুক, যত ধান, তত আয়তনে বাড়ে ; ‘ নিঝরিণী ক্রমে ক্ষুদ্র নদী হইল ক্ষুদ্র নদী ক্রমে বড় নদী হইল, আর জগতসিংহকে দেখা যায় না ; তাঁর অতি উচ্চ, অতি বন্ধুর, অর পদচালন হয় ন। তাহাতে আবার তিলোত্তমীর চরণতলস্থ উপকুলের মৃত্তিক। খণ্ডে খণ্ডে খসিয় গম্ভীরনাদে জলে পড়িতে লাগিল ; নাচে প্রচণ্ড ঘূর্ণিত জলাবৰ্ত্ত, দেখিতে সাহস হয় ম। । তিলোত্তম পৰ্ব্বতে পুনরারোহণ করিয়৷ নদীগ্রাস হইতে পলাইতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন ; পথ বন্ধুর, চরণ চলে না ; তিলোত্তম৷ উচ্চৈঃস্বরে কাদিতে লাগিলেন ; অকস্মাৎ কালমূৰ্ত্তি কতলু খ পুনরুজ্জীবিত হইয়। তাহার পথরোধ করিল ; কণ্ঠের পুষ্পমালা অমনি গুরুভার লৌহখৃঙ্খল হইল, কুসুমনিগড় হস্তচু্যত ভক্টর। আত্মচরণে পড়িল—সে নিগড় অমনি লৌহনিগড় হহয়। বেড়িল ; অকস্মাৎ অঙ্গ স্তম্ভিত হইল ; তখন কতল র্য। তাহার গলদেশে ধরিয়া ঘূর্ণিত করিয়৷ নদাতরঙ্গ প্রবাহ মধ্যে নিক্ষেপ কৰিল । স্বপ্নের কথা সমাপন করিয়! তিলোত্তম সজজঢক্ষে কহিলেন, “যুবরাজ, আমার এ শুধু স্বপ্ন মহে ; তোমার জন্য যে কুসুম-নিগড় রচিয়াছিলাম, বুঝি তাছা সত্যই আত্মচরণে লৌহনিগড় হইয়। ধরিয়াছে, যে কুসুমমাল পরাইয়াছিলাম, তাহ অসির আঘাতে ছিড়িয়াছে।" যুবরাজ তখন হাস্ত করিয়া কর্টিস্থিত অসি তিলেভমার পদতলে রাখিলেন ; কহিলেন, “তিলোত্তম ! তোমার সম্মুখে এই অসিশুন্ত হইলাম, আবার মালা দিয়া দেখ৮–অসি তোমার সম্মুখে দ্বিখণ্ড করিয়া ভাঙ্গিতেছি ।" - তিলোত্তমাকে নিরুত্তর দেখিয়া, রাজকুমার কছিলেন, “তিলোত্তম, আমি কেবল রহস্ত করিতেছি না।” তিলোত্তম লজ্জায় অধোমুখী হইয়া রছিলেন ।