পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কৃষ্ণকাস্তের উইল সুগ্ৰীব, গ্রীবা হেলাইয়া কুম্ভকর্ণের বধের উদ্যোগ করিতেছেন ৷ ইত্যাদি । ব্ৰহ্মানন্দের সে সকল আপদ-বালাই ছিল না, সুতরাং জল আনা, বাসন মাজাট। রোহিণীর ঘাড়ে পড়িয়াছিল । বৈকালে, অন্যান্ত কাজ শেষ হইলে, রোহিণী জল আনিতে যাইত। যে দিনের ঘটনা বিবৃত করিয়াছি, তাহার পরদিন নিয়মিত সময়ে রোহিণী কলসী কক্ষে জল আনিতে যাইতেছিল। বাবুদের বড় একটা পুকুর আছে—নাম বারুণী – জল তার বড় মিঠা-রোহিণী সেইখানে জল আনিতে যাইত। আজিও যাইতেছিল । রোহিণী এক জল আনিতে যায়, দল বাধিয়া যত হালুক। মেয়ের সঙ্গে হালুক হাসি হাসিতে হাসিতে, হালুক। কলসীতে হালুক জল আনিতে যাওয়া রোহিণীর অভ্যাস নহে ! রোহিণীর কলসী ভারী, চালচলনও ভারি। তবে রোহিণী বিধবা । কিন্তু বিধবার মত কিছু রকম নাই । অধরে পানের রাগ, হাতে বালা, ফিভেপেড়ে ধুতি পর, আর কাধের উপর চারুবিনিৰ্ম্মিত কলিভুজঙ্গিনীতুল্য। কুণ্ডলীকৃত লোলায়মনা মনোমোহিনী কবরী । পিতলের কলসী কক্ষে ; চলনের দোলনে, ধীরে ধীরে সে কলসী নাচিতেছে -যেমন তরঙ্গে তরঙ্গে হংসী নাচে, সেইরূপ ধীরে ধীরে গ| দোলাইয়। কলসী নাচিতেছে। চরণ দুইখানি আস্তে আস্তে বৃক্ষচ্যুত পুষ্পের মত মুক্ত মুদ্র মাটীতে পড়িতেছিল—আমনি সে রসের কলসী তালে তালে নাচিতেছিল। হেলিয়া ফুলিয়া, পালভরা জাহাজের মত ঠমকে ঠমকে, চমকে চমকে, রোহিণীসুন্দরী সরোবর-পথ আলো করিয়া জল লইভে আসিতেছিল—এমন সময়ে বকুলের ডালে বসিয়া বসন্তের কোকিল ডাকিল - “কুছঃ ! কুহুঃ ! কুহুঃ !" রোহিণী চারিদিক্‌ চাহিয়া দেখিল । আমি শপথ করিয়৷ বলিতে পারি, রোহিণীর সেই উৰ্দ্ধবিক্ষিপ্ত স্পন্দিত বিলোল কটাক্ষ ডালে বসিয়া যদি সে কোকিল দেখিতে পাটত, তবে সে তখনই ক্ষুদ্র পার্থীজাতি—তখনই সে সে শরে বিদ্ধ হইয়া, উলটিপালটি খাইয়া, প। গোটো করিয়া ঝুপ করিয়া পড়িয়া যাইত। কিন্তু পাখীর অদৃষ্টে তাহা । ছিল না । কার্য্যকারণের অনন্ত শ্রেণী:পরম্পরায় এটি গ্রন্থিবদ্ধ হয় নাই—অথবা পাখীর তত পূৰ্ব্বজন্মার্জিত স্বকৃতি ছিল না । মূখ পাখী আবার ডাকিল— “কুহুঃ ! কুহুঃ ! কুহুঃ ”

  • দুর হ ! কালামুখে৷ ” বলিয়। রোহিণী চলিয়৷ গেল। চলিয়া গেল, কিন্তু কোকিলকে ভুলিল না। আমাদের দৃঢ়তর বিশ্বাস এই ষে, কোকিল

२३=>२ ১১: অসময়ে ডাকিয়াছিল, গরীব বিধবা-যুবতী এক:ি জল আনিভে যাইতেছিল, তখন ডাক ভাল "; নাই । কেন না, কোকিলের ডাক শুনিলেই কতকগুলি বিত্ৰ কথা মনে পড়ে। কি যেন: হারাইয়াছি, যেন তাই হারাইয়। যাওয়ায় জীবন-f সৰ্ব্বস্ব আসার হইয় পড়িয়াছে—যেন তাহা অার : পাইব না। যেন কি নাই, কি যেন নাই, কি ! যেন হইল না, কি যেন পাইব না । কোথায় ষেন রত্ন তারাইয়াছি, কে যেন কঁাদিতে ডাকিতেছে । যেন এ জীবন বৃথায় গেল—মুখের মাত্রা ষেন । পূরিল না—যেন এ সংসারের অনন্ত সৌনর্য্য কিছুই ভোগ করা হইল না। - আবার কুহুং, কুহুং, কুহুঃ ! রোহিণী চাহিয়৷ দেখিল—মুনীল, নিৰ্ম্মল, অনস্ত গগন—নিঃশব্দ, অথচ সেই কুহুরবের সঙ্গে সুর বাধা । দেখিল-নবপ্রস্ফুটিত আমমুকুল—কাঞ্চনগেীর, স্তরে স্তরে স্তরে খামলপত্রে বিমিশ্রিত, শীতল সুগন্ধপরিপূর্ণ কেবল মধুমক্ষিক। ব। ভ্রমরের গুল্গুনে শদিত অথচ সেই কুহুরবের সঙ্গে স্থর বাধ। দেখিল—সরোবর-তীরে গোবিন্দলালের পুষ্পোদ্যান, তাহাতে ফুল ফুটিয়াছে, ঝণকে ঝাকে, লাখে লাখে, স্তবকে স্তবকে, শাখায় শাখায়, পাতায় পাতায়, যেখানে সেখানে ফুল ফুটিয়াছে ; কেহ শ্বেত, কেহ রক্ত, কেহ পীত, কেহ নীল, কেহ ক্ষুদ্র, কেহ। বৃহৎ—কোথাও মৌমাছি, কোথাও ভ্রমর—সেই কুহরবের সঙ্গে সুর বাধা । বাতাসের সঙ্গে তাহার গন্ধ আসিতেছে—ঐ পঞ্চমে বাধ। সুরে । আর সেই কুমুমিত কুঞ্জবনের ছায়াতলে দাড়াইয়া–গোবিন্দলাল নিজে । তাহার অতি নিবিড়কৃষ্ণকুঞ্চিত কেশদাম চক্র ধরিয়া তাহার চম্পকর্যজি নিৰ্ম্মিত স্কন্ধোপরে পড়িয়াছে—কুসুমিতব্ৰক্ষাধিক সুন্দর সেই উন্নত দেহের উপর এক কুমুমিত। লতার শাখ আসিয়া ফুলিতেছে —কি স্থর মিলিল ! এও সেই কুহুরবের সঙ্গে পঞ্চমে বাধ। কোকিল আবার এক অশোকের উপর হইতে ডাকিল, “কুউ ।” তখন রোহিণী সরোবর সোপান অবতরণ করিতেছিল। রোহিণী সোপান অবতীর্ণ হইয়া, কলসী জলে ভাসাইয়া দিয়া কাদিতে বসিল । কেন কঁাদিতে বসিল, তাহা অামি জানি না। আমি স্ত্রীলোকের মনের কথা কি প্রকারে বলিব ? তবে আমার বড়ই সন্দেহ হয়, ঐ দুষ্ট কোকিল রোহিণীকে র্কাদাইয়াছে । 'ई