পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কৃষ্ণকাম্ভের উইল - বন্ধিত করিতে লাগিল । গোবিন্দলাল স্বচ্ছ সরোবরজলে সেই ভাস্করকীৰ্ত্তিকল্প মূৰ্ত্তির ছায়া দেখিলেন, পূর্ণচন্দ্রের ছায়া দেখিলেন এবং কুসুমিত কাঞ্চনাদি বৃক্ষের ছায়া দেখিলেন। সব সুন্দর—কেবল নির্দয়ত৷ অম্বন্দর । স্বষ্টি করুণাময়ী-কুনুষ্য অকরুণ। গোবিন্দ লাল প্রকৃতির স্পষ্টাক্ষর পড়িলেন । রোহিণীকে আবার বলিলেন, “তোমার যদি কোন বিষয়ে কষ্ট থাকে, তবে আজি হউক, কালি হউক, আমাকে জানাইও । নিজে না বলিতে পার, তবে আমাদের বাড়ীর স্ত্রীলোকদিগের দ্বারা জানাইও ।” রোহিণী এবার কথা কহিল । বলিল, “এক দিন বলিব । আজ নহে। এক দিন তোমাকে আমার কথা শুনিতে হইবে ।” গোবিন্দলাল স্বীকৃত হইয়া, গৃহাভিমুখে গেলেন । রোহিণী জলে ঝাপ দিয়া, কলসী ধরিয়া তাহাতে জল পূরিল—কলসী তখন বক্—বক —গলু-গল্ করিয়া বিস্তর আপত্তি করিল। আমি জানি, শূন্য কলসীতে জল পুরিতে গেলে, কলসী, কি মৃতকলসী, কি মনুষ্যকলসী, এইরূপ আপত্তি করিয়া থাকে-বড় গণ্ডগোল করে। পরে অন্তঃশূন্য কলসী পূর্ণতোয় হইলে, রোহিণী ঘাটে উঠিয়া আর্দ্রবস্ত্রে দেহ সুচারুরূপে সমাচ্ছাদিত করিয়া ধীরে ধীরে ঘরে যাইতে লাগিল । তখন "চলং ছলং ঠনাক্‌ ! ঝিনিক ঠিনিকি ঠিন ? বলিয়া কলসীতে আর কলসীর জলেতে আর রোহিণীর বালাতে কথোপকথন হইতে লাগিল। আর রোহিণীর মনও সেই কথোপকথনে আসিয়া যোগ দিল— রোহিণীর মন বলিল—উইল চুরি করা কাজট। জল বলিল—ছলাত । রোহিণীর মন –কাজটা ভাল হয় নাই । বাল বলিল—ঠিন ঠিনা—না ! তা ত না । রোহিণীর মন—এখন উপায় ? কলসী—ঠনক্‌ ঢনক্ ঢন—উপায় আমি ;–দড়ি সহযোগে ।

অষ্টম পরিচ্ছেদ রোহিণী সকাল সকাল পাককার্য্য সমাধা করিয়া, ব্ৰহ্মানন্দকে ভোজন করাইয়া, আপনি অনাহারে শয়নগৃহে দ্বার রুদ্ধ করিয়া গিয়া শয়ন করিল। নিদ্রার জন্য নহে, চিস্তার জন্য । তুমি দার্শনিক এবং বিজ্ঞানবিদগণের মতামত ক্ষশ্বকাল পরিত্যাগ করিয়া আমার কাছে একটা মোট কথা শুন । সুমতি নামে দেবকল্প ও কুমতি নামে রাক্ষসী এই দুই জন সৰ্ব্বদা মনুষের হৃদয়ক্ষেত্রে বিচরণ করে এবং সৰ্ব্বদা পরস্পরের সহিত যুদ্ধ করে। যেমন: দুইটা ব্যাস্ত্রী মৃত গাভী লইয়া পরস্পরে যুদ্ধ করে, যেমনঃ দুই শৃগালী মৃত নরদেহ লইয়া বিবাদ করে, ইহার" জীবন্ত মনুষ্য লইয়৷ সেইরূপ করে । আজ এই বিজন শয়নাগারে রোহিণীকে লইয়া সেই দুই জনে সেইরূপ ঘোর বিবাদ উপস্থিত করিয়াছিল । : সুমতি বলিতেছিল—“এমন লোকেরও সৰ্ব্বনাশ! কুমতি। উইল ত হরলালকে দিই নাই । সৰ্ব্বনাশ কই করিয়াছি ? স্ব। কৃষ্ণকান্তের উইল কৃষ্ণকান্তকে ফিরাইয়। দীও । o: কু। বা ! যখন কৃষ্ণকান্ত আমাকে জিজ্ঞাসা করিবে, “এ উইল তুমি কোথায় পাইলে আর অঙ্কিার দেরাজে একখানা জাল উইল বা কোথা হইতে আসিল, তখন আমি কি বলিব ? কি মজার কথা !" কাকাতে আমাতে দুজনে থানায় যেতে বল না কি ? সু । তবে সকল কথা কেন গোবিন্দলালের কাছে খুলিয়া বলিয়, তাহার পায়ে কাদিয়া পড় না ? সে দয়ালু, অবশু তোমাকে রক্ষা করিবে । - কু। সেই কথা । কিন্তু গোবিন্দলালকে অবশু এ সকল কথা কৃষ্ণকান্তের কাছে জানাইতে হইবে, নইলে উইলের বদল ভাঙ্গিবে না । কৃষ্ণকান্ত যদি থানায় দেয়, তবে গোবিন্দলাল রাখিবে কি প্রকারে ? বরং আর এক পরামর্শ আছে। এখন চুপ করিয়া থাক—আগে কৃষ্ণকান্ত মরুকৃ, তার পর তোমার পরামর্শমতে গোবিন্দলালের কাছে গিয়া তাহার পায়ে” জড়াইয়া পড়িব । তখন তাহাকে উইল দিব। : স্ব। তখন বৃথা হইবে + "ম উইল কৃষ্ণকাস্তের ঘরে পাওয়া যাইবে, তাহাই সত্য বলিয়া গ্রাহ্য হইবে । গোবিন্দলাল সে উইল বাহির করিলে, জালের অপরাদগ্রস্ত হইতে পারে । - কু। তবে চুপ করিয়া থাক—যা হইয়াছে, তা হইয়াছে । সুতরাং মুমতি চুপ করিল—তাহার পরাজয় হইল। তার পর দুই জনে সন্ধি করিয়া সখ্যভাবে আর এক কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইল। সেই বাপীতীর বিরাজিত, চন্দ্রালোকপ্রতিভাসিত, চম্পকদামবিনিৰ্ম্মিত দেবমূৰ্ত্তি; আনিয়া, রোহিণীর মানসচক্ষের অগ্ৰে ধরিল। রোহিণীঃ 路 দেখিতে লাগিল—দেখিতে, দেখিতে, দেখিতে রোহিণী সে রাত্রে ঘুমাইল না।