কৃষ্ণকান্তের উইল রক্ষামুরোধে কিছুই করিতে পারিল না । শেষে সিদ্ধান্ত করিল, যে প্রকারে প্রকৃত উইল চুরি করিয়া জাল উইল রাখিয়া আসিয়াছিল, সেই প্রকারে আবার প্রকৃত উইল রাখিয়া তৎপরিবর্তে জাল উইল লইয়| আসিবে । নিশীথকালে, রোহিণীসুন্দরী প্রকৃত উইলখানি লইয়া সাহসে ভর করিয়৷ একাকিনী কৃষ্ণকান্ত রায়ের^ গৃহাভিমুখে যাত্রা করিলেন । খিড়কীর দ্বার রুদ্ধ, সদর-ফটকে যথায় দ্বারবানের চারপাইয়ে উপবেশন করিয়া অৰ্দ্ধ-নির্মালিতনেত্ৰে, অৰ্দ্ধ রুদ্ধকণ্ঠে, পিলু রাগিণীর পিতৃশ্ৰাদ্ধ করিতেছিলেন, রোহিণী সেইখানে উপস্থিত হইল। দ্বারবানেরা জিজ্ঞাস করিল, “কে তুই ?” রোহিণী বলিল “সখী ।" সখী বাটীর এক জন যুবর্তী চাকরাণী, সুতরাং দ্বারবানের। তার কিছু বলিল না। রোহিণী নিৰ্ব্বিঘ্নে গৃহমধ্যে প্রবেশ পূৰ্ব্বক পূৰ্ব্বপরিচিত পথে রঞ্চকান্তের শয়নকক্ষে গেলেন -পুরী সুরক্ষিত বলিরা কৃষ্ণকান্তের শরনগৃহেয় দ্বার রুদ্ধ ইষ্টত ন। । প্রবেশকালে কান পতিয়| রোহিণী শুনিল যে, অবাধে কৃঞ্চকান্তের নাসিক গর্জন হইতেছে। তথন ধীরে ধীরে বিনাশব্দে উইলটোর গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল । প্রবেশ করিয়। প্রথমেই দীপ নিপলাপিত করিল। পরে পূর্বমত চাবি সংগ্ৰহ করিল এবং পূৰ্ব্বমত অন্ধকারে দেরাজ খুলিল । রোহিণী অতিশয় সাবধান, হস্ত অতি কোমলগতি । তথাপি চাবি ফিরাষ্টতে খটু করিয়া একটু শব্দ হইল । সেই শব্দে ক্লষ্ণকাস্তের নিদ্রাভঙ্গ হুইল । কৃষ্ণকান্ত ঠিক বুঝিতে পারিলেন না দে, কি শব্দ হইল । কোন সাড় দিলেন ন—কান পাতিয়৷ রহিলেন । রোহিণীও দেখিলেন যে, নাসিকাগর্জনশন্স বন্ধ হইয়াছে। রোহিণী বুঝিলেন, কৃষ্ণকাস্তের ঘুম ভাঙ্গিয়াছে ৷ রোহিণী নিঃশব্দে স্থির হইয়া রঙ্গিলেন । কৃষ্ণকান্ত বলিলেন, “কে ও ?" কেহ কোন উত্তর দিল না । সে রোহিণী আর নাই । রোহিণী এখন শীর্ণ, ক্লিষ্ট, বিবশী—বোধ হয়, একটু ভয় হইয়াছিল ;– একটু নিশ্বাসের শব্দ হইয়াছিল । নিশ্বাসের শব্দ কৃষ্ণকাস্তের কানে গেল । - কৃষ্ণকান্ত হরিকে বার কয় ডাকিলেন । রোহিণী মনে করিলে এই অবসরে পলাইতে পারিত, কিন্তু তাহা হইলে গোবিন্দলালের প্রতীকার হয় না । রোহিণী মনে মনে ভাবিল, “দুষ্কৰ্ম্মের জন্য সে দিন যে সাহস করিয়াছিলাম, আজ সত্বকৰ্ম্মের জন্য তাহা করিতে পারি না কেন ? ধরা পড়ি পড়িব ।” st রোহিণী পলাইল না । কৃষ্ণকান্ত কয়বার হরিকে ডাকিয়া কোন উত্তর, পাইলেন না। হরি স্থানান্তরে সুখানুসন্ধানে গমন । করিয়াছিল—শীঘ্ৰ আসিবে । তখন কৃষ্ণকান্ত উপাধানতল হইতে অগ্নিগর্ভ দীপশলাক গ্রহণপূর্বক সংসা আলোক উৎপাদন করিলেন । শলাকালোকে দেখিলন, গৃহমধ্যে দেরাজের কাছে স্ত্রীলোক । জালিত শলাকসংযোগে কৃষ্ণকান্ত বাতি জালিলেন । স্ত্রীলোককে সম্বোধন করিয়া বলিলেন “তুমি কে y রোহিণী ক্লঞ্চকাস্তের কাছে গেল । বলিল, “আমি রোহিণী ।” কৃষ্ণকান্ত বিস্থিত হইলেন, বলিলেন "এত রাত্রে অন্ধকারে এখানে কি করিতেছিলে ?” রোহিণী বলিল, "চুরি করিতেছিলাম।” কৃষ্ণ । রঙ্গ-রহস্য রাখ । কেন এ অবস্থায় তোমাকে দেখিলাম, বল। তুমি চুরি করিতে আসিয়াছ, এ কথা সহসা আমার বিশ্বাস হয় না। কিন্তু চোরের অবস্থাতেই তোমাকে দেখিতেছি । রোহিণী বলিল, “তবে আমি যাহা করিতে আসিয়াছি, তাহা আপনার সম্মুখেই করি, দেখুন। পরে আমার প্রতি যেমন ব্যবহার উচিত হয়, করিবেন । আমি ধরা পড়িয়াছি, পলাইতে পারিব ন। । পলাইব না ।" এই বলিয়া রোহিণী দেরাজের কাছে প্রত্যাগমন করিয়া দেরাজ টানিয়। খুলিল। তাহার ভিতর হইতে জাল উইল বাহির করিয়া প্রকৃত উইল সংস্থাপিত করিল। পরে জাল উইলখানি খণ্ড খণ্ড করিয়া ফাড়িয়! ফেলিল । “হঁ। ষ্টা, ও কি ফড়ি ? দেখি দেখি,” বলিয়া কৃষ্ণকান্ত চীৎকার করিলেন । কিন্তু তিনি চীৎকার করিতে করিতে রোহিণী সেই খণ্ডে খণ্ডে বিচ্ছিন্ন উইল অগ্নিমুখে সমৰ্পণ করিয়া ভস্মাবশেষ করিল। কৃষ্ণকান্ত ক্রোধে লোচন আরক্ত করিয়া বলিলেন, “ও কি পোড়াইলি ?” রোহিণী । একখানি কৃত্রিম উইল । কৃষ্ণকান্ত শিহরিয়া উঠিলেন, “উইল ! উইল । আমার উইল কোথায় ?” রে। আপনার উইল দেরাজের ভিতরে আছে, আপনি দেখুন না । এই যুবতীর স্থিরতা—নিশ্চিন্তত দেখিয়া কৃষ্ণকান্ত । বিস্মিত হইতে লাগিলেন। ভাবিলেন, “কোন দেবতা । ছলনা করিতে আসেন নাই ত?”
পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৯৫
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।