কৃষ্ণকান্ত তখন দেরাজ খুলিয়া দেখিলেন, এক খানি উইল তন্মধ্যে আছে। সেখানি বাহির করিলেন, চশমা বাহির করিলেন। উইলখানি পড়িয়া দেখিয়৷ জানিলেন, তাহার প্রকৃত উইল বটে। বিস্মিত হইয়৷ পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি পোড়াইলে কি ?” রে। একখানি জাল উইল । কৃ। জাল উইল ? জাল উইল কে করিলা? তুমি তাহা কোথায় পাইলে ? রে। কে করিল, তাহ বলিতে পারি না—উহ আমি এই দেরাজের মধ্যে পাইয়াছি । কু। তুমি কি প্রকারে সন্ধান জানিলে যে, দেরাজের ভিতর কৃত্রিম উইল আছে ? রে। । তাহা আমি বলিতে পারিব না । কৃষ্ণকান্ত কিয়ৎকাল চিন্ত| করিতে লাগিলেন । শেষে বলিলেন, “যদি আমি তোমার মত স্ত্রীলোকের ক্ষুদ্র-বুদ্ধির ভিতরে প্রবেশ করিতে ন পারিব, তবে এ বিষয়সম্পত্তি এত কাল রক্ষা করিলাম কি প্রকারে ? এ জাল উইল হরলালের তৈয়ারি । বোধ হয়, তুমি তাহার কাছে টাক খাইয়! জাল উইল রাখিয়া আসল উইল চুরি করিতে আসিয়াছিলে । তার পর ধর পড়িয়া ভয়ে জাল উইলখানি ছিড়িয়া ফেলিয়াছ । ঠিক কথা কি না ?” রেী । তাহী নহে । কু। তাহা নহে? তবে কি ? রে। আমি কিছু বলিব না। আমি আপনার ঘরে চোরের মত প্রবেশ করিয়াছিলাম, আমাকে যাহ। করিতে হয়, করুন। কৃ। তুমি মন্দ কৰ্ম্ম করিতে আসিয়াছিলে সনোহ নাই, নহিলে এ প্রকারে চোরের মত আসিবে কেন ? তোমার উচিত দণ্ড অবশু করিব । তোমাকে পুলিসে দিব না, কিন্তু কাল তোমার মাথ। মুড়াইয়া ঘোল ঢালিয়া গ্রামের বাহির করিয়া দিব। আজ তুমি কয়েদ থাক । রোহিণী সে রাত্রে আবদ্ধ রহিল । দশম পরিচ্ছেদ সেই রাত্রের প্রভাতে শয্যাগৃহে মুক্ত বাতায়নপথে ট্রাড়াইয়া গোবিন্দলাল। ঠিক প্রভাত হয় নাই— কিছু বাকি আছে। এখনও গৃহপ্রাঙ্গণস্থ কামিনীকুঞ্জে কোকিল প্রথম ডাক ডাকে নাই। কিন্তু দোয়েল গীত আরম্ভ করিয়াছে ৷ উষার শীতল বাতাস উঠিয়াছে—গোবিন্দলাল বাতায়ন-পথ মুক্ত করিয়া সেই উদ্যানস্থিত মল্লিকা-গন্ধরাজ কুটজের পরিমলবাহী শীতল প্রভাত-বায়ু সেবন জন্য তৎসমীপে দাড়াইলেন । অমনি তাহার পাশে আসিয়া একটি ক্ষুদ্রশরীরা বালিকা দাড়াইল । গোবিন্দলাল বলিলেন, “আবার তুমি এখানে কেন ?" 修 বালিকা বলিল, “তুমি এখানে কেন ?” বলিতে হইবে না ষে, এই বালিকা গোবিন্দলালের স্ত্রী। গোবিন্দ। আমি একটু বাতাস খেতে এলেম, তাও কি তোমার সইল না ? বালিকা বলিল, “সবে কেন ? এখনই আবার খাই খাই ? ঘরের সামগ্ৰী খেয়ে মন উঠে না, আবার মাঠেঘাটে বাতাস খেতে উকি মারেন ।” গো। ঘরের সামগ্রী এত কি খাইলাম ? “কেন, এইমাত্র আমার কাছে গালি খাইয়াছ ।” গোবিন্দ । জান না, ভোমরা ! গালি খাইলে যদি বাঙ্গালীর ছেলের পেট ভরিত, তাহা হইলে এ দেশের লোক এত দিনে সগোষ্ঠী বদহজমে মরিয়া যাইত । ও সামগ্ৰীটি অতি সহজে বাঙ্গালীর পেটে জীর্ণ হয়। তুমি আর এক বার নথ নাড়ো, ভোমরা ! আমি আর একবার দেখি । গোবিন্দলালের পত্নীর যথার্থ নাম কৃষ্ণমোহিনী, কি কৃষ্ণকামিনী, কি অনঙ্গমঞ্জরী, কি এমনই একটা কি তাহার পিতামাত রাখিয়াছিল, তাহ ইতিহাসে লেখে না । অব্যবহারে সে নাম লোপ প্রাপ্ত হইয়াছিল । তাহার আদরের নাম "ভ্রমর” বা “ভোমরা ” সার্থকতাবশতঃ সেই নামই প্রচলিত হইয়াছিল । ভোমরা কালে । ভোমরা নথ নাড়ার পক্ষে বিশেষ আপত্তি জানাইবার জন্য নথ খুলিয়া, একটা হুকে রাখিয়া, গোবিন্দলালের নাক ধরিয়া নাড়িয়া দিল । পরে গোবিন্দলালের মুখপানে চাহিয়া মৃদ্ধ মুছ হাসিতে লাগিল,—মনে মনে জ্ঞান, যেন বড় একটা কীৰ্ত্তি করিয়াছি। গোবিন্দলালও তাহার মুখ পানে চাহিয়া অতৃপ্তলোচনে দৃষ্টি করিতেছিলেন। সে সময়ে স্বর্য্যেদয়স্থচক প্রথম রশ্মিকিীট পূৰ্ব্বগগনে দেখা দিল— তাহার মৃতুল জ্যোতিঃপুঞ্জ ভূমণ্ডলে প্রতিফলিত হইতে লাগিল। নবীনালোক পূৰ্ব্বদিক হইতে | পূৰ্ব্বমুখী ভ্রমরের মুখের উপর পড়িয়াছিল। উজ্জল, পরিষ্কার, কোমল, খামচ্ছবি মুখকাস্তির উপর কোমল প্রভাতালোক পড়িয়া তাহার বিস্ফারিত লীলাচঞ্চল চক্ষের উপর জলিল, তাহার মিথোজ্জল
পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৯৬
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।