পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

"לל ভ্রমর বলি বলি করিয়া বলিতে পারিল না। লজ্জাবনতমুখী হইয়া নীরবে রহিল । গোবিন্দলাল বুঝিলেন । আগেই বুঝিয়াছিলেন । আগেই বুঝিয়াছিলেন বলিয়া এত পীড়াপীড়ি করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন । রোহিণী ষে নিরপরাধিনী, ভ্রমরের তাহা দৃঢ়বিশ্বাস হইয়াছিল। আপনার অস্তিত্বে যতদুর বিশ্বাস, ভ্রমর উহার নির্দোযিতায় ততদূর বিশ্বাসবতী । কিন্তু সে বিশ্বাসের অন্ত কোনই কারণ ছিল না--কেবল গোবিন্দলাল বলিয়াছেন যে, “সে নির্দোষ, অামার এইরূপ বিশ্বাস ।” গোবিন্দলালের বিশ্বাসেই ভ্রমরের বিশ্বাস । গোবিন্দলাল তাহা বুঝিরাছিলেন। ভ্রমরকে চিনিতেন । তাই সে কালে। এত ভালবাসিতেন । হাসিয়া গোবিন্দলাল বলিলেন, “আমি বলিব, কেন তুমি রোহিণীর দিকে ?" ভ্র । কেন ? গে। সে তোমায় কালে না বলিয়৷ উজ্জ্বল স্থামরণ বলে । ভ্রমর কোপকুটিল কটাক্ষ করিয়া বলিল, “যাও।” গোবিন্দলাল বলিলেন, “যাই ।” এই বলিয়। গোবিন্দলাল চলিলেন । ভ্রমর তাহার বসন পরিল, —“কোথায় ষ ও ?" গে। কোথা যাই বল দেখি ? ভ্র । এবার বলিব ? গে । বল দেখি ? ভ্র। রোহিণীকে বঁাচাইতে । “তাই।” বলির গোবিন্দলাল ভোমরার মুখচুম্বন করিলেন । পরদুঃখ কান্তরের হৃদয় পরতেঃখকাতরে বুঝিল-তাই গোবিন্দলাল ভ্রমরের মুখচুম্বন করিলেন । একাদশ পরিচ্ছেদ গোবিন্দলাল কৃষ্ণকান্ত রায়ের সদর-কাছারীতে গিয়া দর্শন দিলেন । কৃষ্ণকান্ত প্রাতঃকালে কাছারীতে বসিয়াছিলেন, গদির উপর মসনদ করিয়৷ বসিয়া, সোনার আলবোলায় অম্বুরী তামাক চড়াইয়া মৰ্ত্ত্যলোকে স্বর্গের অনুকরণ করিতেছিলেন । একপাশ্বে রাশি রাশি দপ্তরে বাধা চিঠ, খতিয়ান, দাখিলা, জমাওয়াশীল, থোকা, করচ, বাকি জায়, শেহী, রোকড়—আর একপার্থে নায়েব, গোমস্ত, কারকুন, মুহুরী, তহশীলদার, •আমীন, পাইক, প্রজা । সম্মুখে অধোবদন অবগুণ্ঠনবতী রোহিণী । গোবিন্দলাল আদরের ভ্রাতু-পুত্র। প্রবেশ করি য়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হয়েছে, জ্যেঠা-মহাশয় ?” তাহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া, রোহিণী অবগুণ্ঠন ঈষৎ মুক্ত করিয়া তাহার প্রতি ক্ষণিক কটাক্ষ করিল। কৃষ্ণকান্ত র্তাহার কথার কি উত্তর করিলেন, তৎপ্রতি গোবিন্দলাল বিশেষ মনোযোগ করিতে পারিলেন না । ভাবিলেন, সেই কটাক্ষের অর্থ কি ? শেষ সিদ্ধাস্ত করিলেন, এ কাতর কটাক্ষের অর্থ—ভিক্ষা ।” কি ভিক্ষ ? গোবিন্দলাল ভাবিলেন, আর্তের ভিক্ষ আর কি ? বিপদ হইতে উদ্ধার। সেই বাপী তীরে সোপানোপরে দাড়াইয়। যে কথোপকথন হইয়াছিল, তাহাও তাহার এই সময়ে মনে পড়িল। গোবিন্দলাল রোহিণীকে বলিয়াছিলেন, “তোমার যদি কোন বিঘরের কৃষ্ট থাকে, তবে আজি হউক, কালি হউক, আমাকে জানাইও ।” আজি ত রোহিণীর কষ্ট বটে, বুঝি এই ইঙ্গিতে রোহিণী তাহাকে তাহ জানাইল । গোবিন্দলাল মনে মনে ভাবিলেন, “তোমার মঙ্গল সাধি, ইহা আমার ইচ্ছা ; কেন না, ইহলোকে তোমার সহায় কেহ নাই দেখিতেছি। কিন্তু তুমি যে লোকের হাতে পড়িয়াছ, তোমার রক্ষা সহজ নহে।” এই ভাবিপ্ন। প্রকণ্ঠে জ্যেষ্ঠ-তাতকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হয়েছে, জেঠমহাশয় ?” বৃদ্ধ কৃষ্ণকান্ত একবার সকল কথা আনুপুৰ্ব্বিক গোবিন্দলালকে বলিয়াছেন, কিন্তু গোবিন্দলাল রোহিণীর কটাক্ষের ব্যাখ্যায় ব্যতিব্যস্ত ছিলেন, কানে কিছুষ্ট শুনেন নাই । ভ্রাতুপুত্র আবার জিজ্ঞাস করিল, “কি হয়েছে, জ্যেঠামহাশয় ?” শুনিয়া বুদ্ধ মনে মনে ভবিল, “কি হয়েছে ! ছেলেট বুঝি মাগীর চাদপান। মুখখান। দেখে ভুলে গেল !" কৃষ্ণকান্ত আবার আত্নপূর্বক গতরাত্রের বৃত্তাস্ত গোবিন্দলালকে শুনাইলেন । সমাপন করিয়া বলিলেন, “এ সেই হল পাজির কারসাজি । বোধ হইতেছে, এ মাগী তাহার কাছে টাক। খাইয়া জল উইল রাখিয়া আসল উইল চুরি করিবার জন্য আসিয়াছিল। তার পর ধরা পড়িয়া ভয়ে জাল উইল ছিড়িয়া ফেলিয়াছে।” গো । রোহিণী কি বলে ? কৃ। ও আর বলিবে কি ? বলে, তা নয় । গোবিন্দলাল রোহিণীর দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ত নয় ত তবে কি রোহিণি ?” রোহিণী মুখ না তুলিয়া গদগদকণ্ঠে বলিল, “আমি আপনাদের হাতে পড়িয়াছি, যাই করিবার হয় করুন। আমি আর কিছু বলিব না।” -